এবার রূপপুর বালিশকাণ্ডকে হার মানিয়ে যন্ত্র ও সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতির নতুন নজির স্থাপন করা হয়েছে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে।
ওই হাসপাতালের জন্য ১৬৬টি যন্ত্র ও সরঞ্জাম কেনাকাটায় হরিলুটের অভিযোগ ওঠেছে সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হাসপাতালটির যন্ত্র ও সরঞ্জাম কেনাকাটাতে দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে। এ ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)কে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘নাগরিক টিভি’তে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে।
অনুসন্ধানের জানা গেছে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটির অব্যবহৃত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) জন্য একটি পর্দা কেনা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে। বর্তমানে যার বাজার মূল্য হবে ২০ হাজার টাকা।
১০ হাজার টাকার ডিজিটাল ব্লাড প্রেশার মেশিন কেনা হয়েছে ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। এভাবে প্রায় ১৮৬ গুণ পর্যন্ত বেশি দাম দিয়ে ১৬৬টি যন্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনিক ট্রেডার্স।
জানা গেছে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্পে এমন দামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স অনিক ট্রেডার্স এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। এর সাথে সে সময়কালে হাসপাতালের শীর্ষ কর্মকর্তারাও সম্পৃক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হাসপাতালের পর্দা ও ব্লাড প্রেশার মেশিনের মতো অব্যবহৃত আইসিইউর জন্য অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্ট কেনা হয়েছে ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইসিইউতে রোগীদের কৃত্রিম শ্বাস-প্রসাশ্বের জন্য ব্যবহার করা এ প্ল্যান্ট যদি আমেরিকার তৈরি মেশিন হয় তাহলে সর্বোচ্চ খরচ পড়বে ১ কোটি টাকা। আর যদি জাপানিজ হয় তাহলে খরচ পড়বে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা। আর যদি চাইনিজ হয় তাহলে খরচ কমে আসবে ৪০ লাখ টাকার নিচে।
অনিয়ম দুর্নীতির এখানেই শেষ নয়। হাসপাতালে ভ্যাকুয়াম প্ল্যান্টে খরচ দেখানো হয়েছে ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ প্ল্যান্ট স্থাপনে মেশিনের মানভেদে সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা।
একইভাবে বিআইএস মনিটরিং প্ল্যান্ট স্থাপনে ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ দেখিয়েছে অনিক ট্রেডার্স। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ প্ল্যান্টটির স্থাপনে সবোর্চ্চ খরচ পড়ার কথা ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা।
এছাড়া অনিক ট্রেডার্স প্রতিটি হেড কার্ডিয়াক স্টেথোস্কোপের দাম দেখিয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার টাকা। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে. প্রতি পিস সবচেয়ে ভাল মানের হেড কার্ডিয়াকের দাম সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের এক অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব যন্ত্রপাতির যে দাম দেখানো হয়েছে তা একেবারেই কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে এসবের কেনো মিল নেই।
তিনি বলেন, শহরে সাধারণত ১০ বেডের আইসিইউ করা হয়ে থাকে। ভাল মানের একটি আইসিইউ করতে সব মিলিয়ে ৫ থেকে ৭ কোটি টাকা খরচ হয়। অথচ এখানে একটি প্ল্যান্টের দামই ৫ কোটি টাকার বেশি দেখানো হয়েছে। সুতরাং ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে যেটা হয়েছে সেটা এক কথায় ভয়াবহ লুটপাট।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অনিক ট্রেডার্স ১১ কোটি ৫৩ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে। অথচ প্রতিষ্ঠানটি বিল দেখিয়েছে ৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭১ হাজার টাকা। অর্থাৎ কেনাকাটায় অনিক ট্রেডার্স প্রায় ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা বেশি বিল দেখায়।
দুর্নীতির অভিযোগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স অনিক ট্রেডাসের প্রায় ১০ কোটি টাকার বিল বছর খানেক আগে আটকে দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পরে বিল পরিশোধের আবেদন জানিয়ে ২০১৭ সালের ১ জুন রিট করে প্রতিষ্ঠানটি।
মেসার্স অনিক ট্রেডাসের রিটের পর জানা যায়, ওই সময়কালে হাসপাতালের শীর্ষ কর্মকর্তারাও এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই অবস্থায় ছয় মাসের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) তদন্ত শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল্লাহ মাহমুদ বাশার বলেন, এক রোগী থেকে আরেক রোগীকে আড়াল করার পর্দার দাম ধরা হয়েছে ৩৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। বাজার মূল্যের সাথে কোনোভাবেই এটি সঠিক মূল্য নির্ধারণ বলা যাবে না।
তিনি বলেন, যারা দায়িত্বশীল ব্যক্তি ছিলেন তারা যেহুতো এ ঘটনায় সম্পৃক্ত। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শুধু প্রশাসনিক নয়, আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। তবে সেটা দুদক তদন্ত সাপেক্ষে নির্ধারণ করবে।
জানতে চাইলে মেসার্স অনিক ট্রেডাসের রিট পিটিশনার ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অনিক ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ফোন নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. কামদা প্রাসাদ বলেন, যে সময় এ কেনাকাটা হয়েছে তখন আমি এখানে ছিলাম না। সুতরাং এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না।
এর আগে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য একেকটি বালিশ কেনা হয়েছিল সাড়ে ৬ হাজার টাকা করে। সূত্র- সময়ের কণ্ঠস্বর, পরিবর্তন