১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর এই মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের বিচারে মাত্র একটি খুনের অপরাধে প্রথম ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত হন একজন পাকিস্থানী দোসর বা রাজাকার। তার নাম চিকন আলী। দেশে প্রথম ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত সেই রাজাকার চিকন আলীকে নিয়ে তখন দেশের সকল সংবাদপত্রে ব্যাপক লেখালেখি হয়। রাজাকার চিকন আলীর ফাঁসির রায় সম্পর্কিত ঘটনাটি তৎসময়ের অন্যতম জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম বিবিসিতে বিখ্যাত বৃটিশ সাংবাদিক মার্কটালী প্রকাশ করলে চিকন আলীর নাম বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘপ্রায় ৪০ বছর পর সেই বিখ্যাত সাংবাদিক মার্কটালী ৭ জানুয়ারী-২০১২ থেকে ২ দিন ব্যাপি ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে যুব কনভেনশন’এ আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন।
কে এই রাজাকার চিকন আলী?
আমাদের দেশে অতি প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে চিকন আলীর যদি ফাঁসি হয় তবে মোটা আলীর কি হবে? প্রবাদের এই চিকন আলী শুধু তার নামের কারণেই নয় কিছু নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় তিনি খলনায়কের স্থান পেয়েছিলেন। কে এই চিকন আলী। কেউ কেউ জানলেও অনেকেই চিকন আলীর সম্বন্ধে জানেন না। বর্তমান প্রজন্ম এবং চিকন আলী সম্পর্কে না জানা পাঠকদের জানানোই এ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য।
কুষ্টিয়া মিরপুর পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডের মৃত মকিম প্রামাণিকের পুত্র চিকন আলী প্রামাণিক (৭১)। ইতিহাসের খলনাযক চিকন আলীর সঠিক জন্ম তারিখ জানা না গেলেও চিকন আলী মৃত্যুবরণ করেন ১৩ অক্টোবর ২০০৩ সালে । দুই স্ত্রীর সংসার ছিল চিকন আলীর। বড় বউ সায়লার ঘরে একমাত্র সন্তান মজিদ (৪৮) । ২য় স্ত্রী সালেহা বেগম । এই ঘরে লিটন (৩৮) নামের আরও একটি পুত্র সন্তান রয়েছে । যদ্দূর জানা যায়, দেশ স্বাধীনের জন্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ওসুরের মত শক্তি সামর্থ্যরে অধিকারী নিরক্ষর চিকন আলী যুদ্ধে অংশ নেয় পাকিস্তানী হানাদারদের পক্ষে। যার কারণে চিকন আলীকে বলা হতো রাজাকার চিকন আলী।
চিকন আলী স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকারদের কমান্ডার নয় একজন সিপাহী ছিলেন। যুদ্ধের সময় চিকন আলীর বয়স ছিল আনুমানিক ২৬/২৭ বছর। এই সময় মিরপুর সমবায় অফিসের নিম্ন কর্মচারী আব্দুল গফুরের সুন্দরী কন্যা দুলালীর সাথে চিকন আলীর ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুলালীকে নিয়ে আব্দুল গফুর বর্তমান মিরপুর পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের আর.ই অফিস এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। ভালবাসার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলের সময় গফুর তার অপরুপা সুন্দরী কন্যা দুলালীকে আর.ই অফিস এলাকার তৎকালীন মাতব্বর রিজদ্দির জীম্মায় রেখে যায়। দুলালীকে দেখতে না পেয়ে উতলা হয়ে পড়ে রাজাকার চিকন আলী।
এভাবে এক দুই দিন করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন কোন এক রাতে চিকন আলী থ্রী নট থ্রী রাইফেল নিয়ে হাজির হয় প্রেমিকা দুলালীর জীম্মাদার রিজদ্দির বাড়িতে। রিজদ্দির বাড়িতে ঢুকে প্রথমে বিভিন্ন কৌশলে চিকন আলী দুলালীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। বাধা দেয় রিজদ্দি। বাধা উপেক্ষা করে রিজদ্দির উপর গুলি চালায় চিকন আলী। ঘটনাস্থলেই মারা যায় রিজদ্দি। হত বিহব্বল হয়ে পড়ে চিকন আলী । গুলির শব্দ শুনে এলাকাবাসি ছুটে আসে রিজদ্দির বাড়িতে। জনতা খুনি রাজাকার চিকন আলীকে আটকাবার চেষ্টা করে। এ সময় চিকন আলী আত্মরক্ষার্থে তার হাতে থাকা থ্রী নট থ্রী রাইফেল উঁচিয়ে ফায়ার করলে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এই সুযোগে চিকন আলী মিরপুর কুরিপোল, পাহাড়পুর, তালবাড়ীয়া রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে ভোর বেলা দৌলতপুর উপজেলার বড়গাংদিয়া হাটে পৌঁছায়। এই হাট থেকে একটি খেজুরের পাটি কিনে তার মধ্যে বন্দুকটি লুকিয়ে রেখে দিনটি অতিবাহিত করে। এরপর চিকন আলী বিভিন্ন মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে ভারতের করিমপুর গিয়ে ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরির সাথে সাক্ষাৎ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে।
বুদ্ধিদীপ্ত সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরি মিরপুর উপজেলার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের কাছে চিকন আলীর সম্বদ্ধে জানতে চাইলে তারা চিকন আলী রিজদ্দিকে খুন করে পালিয়েছে জানালে চিকন আলীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে যায়। যদিও এরপর চিকন আলী তৎকালীন দৌলতপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নজরুল ইসলামের বডিগার্ড হিসেবে বেশ কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এরই মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। রিজদ্দি খুনের আসামি হিসেবে গ্রেফতার হয় চিকন আলী। মামলাটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর কুষ্টিয়া জজ কোর্টের বিচারক আর কে বিশ্বাস রাজাকার চিকন আলীর বিরুদ্ধে ফাঁসির দন্ড প্রদান করেন। চিকন আলীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় নবগঠিত বাংলাদেশ চালু হওয়া বিচার ব্যবস্থায় খুনের দায়ে প্রথম ফাঁসির দন্ড।
একটিমাত্র খুন করে চিকন আলীর যদি ফাঁসি হয় তাহলে অসংখ্য খুন করা মোটা আলীদের কি হবে? এই বাক্যটিকে মুখ্য করে চিকন আলীর পক্ষের আইনজীবী মীর আতিয়ার রহমান ফাঁসির দন্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেন। আপিলের রায়ে রাজাকার চিকন আলীর ফাঁসির দন্ড রহিত হয়ে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড হয়। দীর্ঘ ৯ বছর ৩ মাস জেল খেটে রাজাকার চিকন আলী ৮০ দশকের গোড়ার দিকে কারামুক্ত হয়েছিলেন।