Thursday, March 28, 2024
প্রচ্ছদকুষ্টিয়ামিরপুরযে জমিদারকে ব্রিটিশরাও ভয় পেত!

যে জমিদারকে ব্রিটিশরাও ভয় পেত!

Published on

আজ থেকে প্রায় আড়াইশত বছর আগে এমন একজন জমিদার ছিলেন, যার নাম শুনলে আমলা-সদরপুর অঞ্চলে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খেতো। কালের বিবর্তনে তা বিলীন হয়ে গেছে। পড়ে আছে শুধুই স্মৃতিচিহ্ন। লোকমুখে শোনা যায়, জমিদার রামানন্দ সিংহ রায়ের বাড়ির সামনে দিয়ে নাকি জুতা, সেন্ডেল, ছাতা এমনকি সাইকেল চালিয়ে যেতেও সাহস পেত না কেউ। পরাক্রমশালী জমিদারের নাম ছিলো রামানন্দ সিংহ রায়।

ইংরেজি ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে যখন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পরাজিত হন, ঠিক তার পরপরই জমিদার রামানন্দ সিংহ রায় জমিদারির ভার গ্রহণ করেন। তৎকালীন কাশীমনগর ও ৩১৭ রাজাপুর ছিল তার জমিদারির এলাকা। তারপর আস্তে আস্তে তার জমিদারি বাড়তে থাকে।

পরবর্তীতে গোয়ালন্দ ঘাট থেকে পদ্মার লালগোলা ঘাট পর্যন্ত তিনি জমিদারি লাভ করেন। তিনি তখন এ অঞ্চলের প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন।

জমিদার রামানন্দ সিংহ রায়ের এক বংশপরম্পরা কর্মচারী আব্দুর রহমান জানান, বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার আমলা ইউনিয়ন ব্রিটিশ আমলে এম.জেড কোম্পানির নীল চাষের প্রধান এলাকায় পরিণত হয়।

এ নীল চাষ নিয়ে জমিদার রামানন্দ সিংহ রায় ও প্যারী সুন্দরীর সাথে ব্রিটিশদের সাথে বিরোধ শুরু হয়। সেই বিরোধ আস্তে আস্তে দানা বেধে ওঠে। পরবর্তী সময়ে তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেধে যায়।

এ অঞ্চলের মাটি নীল চাষের উপযোগী হওয়ায় তারা এখানে ব্যাপকভাবে নীল চাষ করত। যেহেতু জমিদার রামানন্দ সিংহ রায় এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন, সেহেতু ব্রিটিশ সাহেবরা তার বাড়িতে যাওয়া-আসা করতো। জমিদার রামানন্দ সিংহ রায়ের কোনো ছেলে সন্তান ছিলো না। তার দুটি সন্তানই ছিলো মেয়ে। বড় মেয়ে প্যারী সুন্দরী ও ছোট মেয়ে শ্যামা সুন্দরী। জমিদার রামানন্দ সিংহ রায়ের বড় মেয়েকে পছন্দ করেন তৎকালীন ব্রিটিশ এন.জেড কোম্পানির একজন কর্মকর্তা টমাস আইভান কেনি। তারপর তিনি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। জমিদারের এত বিশাল প্রভাব ও তার মেয়ে খুব সুন্দরী হওয়ায় তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন জমিদার রামানন্দ সিংহ রায়।

এদিকে ব্রিটিশ কর্মকর্তা টমাস আইভান কেনি জেদ করেন যে, তিনি প্যারী সুন্দরীকেই বিয়ে করবেন। ফলে, রাতের আঁধারে জমিদারের মেয়ে প্যারী সুন্দরীকে তুলে নিয়ে যাবার নির্দেশ দেন ব্রিটিশ কর্মকর্তা। ব্রিটিশ সৈন্যরা যখন রাতের আঁধারে জমিদার রামানন্দ সিংহ রায়ের বাড়িতে আক্রমণ করেন, তখন রামানন্দ সিংহ রায় তার বাড়ির ৩টি মেইন গেটের মধ্যে ২টি খুলে দেন। রামানন্দ সিংহ রায়ের বাড়ির গেটগুলো ছিলো এমন, যে তাতে একত্রে একজন লোক ছাড়া দুইজন প্রবেশ করতে পারবে না। একে একে ব্রিটিশ সৈন্যরা যখন বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে, ঠিক তখনই বাইরের তৃতীয় গেট বন্ধ করে দিয়েছিলেন রামানন্দ সিংহ এবং তারই নির্দেশে জমিদারের লোকেরা ব্রিটিশদের উপর পাল্টা আক্রমণ করেছিলো। এক পর্যায়ে ১০০ ব্রিটিশ সৈন্যর মাথা কেটে জমিদার বাড়ির ড্রেন দিয়ে পাশের নদীতে ফেলে দিয়েছিলো। মানুষের রক্তে ঐ নদীর পানি লাল হয়ে গিয়েছিলো। তার পর থেকেই ঐ নদীর নাম হয় সাগরখালী নদী।

আমলা সদরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি মাজেদুর আলম বাচ্চু জানান, এক রাতে এত ব্রিটিশ সৈন্যর মৃত্যুর পর জমিদার রামানন্দ সিংহ রায়ের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ব্রিটিশরা এবং তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন বৃটিশ সরকার। আর তাই জমিদার রামানন্দ সিংহ রায় তার দুই মেয়েকে নিরাপদ স্থানে রেখে রাতের আঁধারে ছদ্মবেশে ইংল্যান্ডে চলে যান। ইংল্যান্ডে তিনি মহারানী ভিক্টোরিয়ার কাছে আশ্রয় নেন। মহারানী তার সুন্দর ব্যবহার ও চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে তাকে তার সন্তান হিসেবে রেখে দেন। রামানন্দ সিংহ রায় মহারানীকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করতেন।

এভাবে কিছুদিন থাকার পরে রামানন্দ সিংহ রায় মহারানী ভিক্টোরিয়াকে তার ১০০ ব্রিটিশ সৈন্য হত্যার সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। যেহেতু মহারানী ভিক্টোরিয়া রামানন্দ সিংহ রায়কে নিজের ছেলের মতো দেখতেন, সেহেতু মহারানী রামানন্দ সিংহ রায়কে ব্রিটিশ সরকারের কাছে নিজের ভুল শিকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেন। মহারানী ভিক্টোরিয়ার সুপারিশে ব্রিটিশ সরকার রামানন্দ সিংহ রায়কে ক্ষমা করে দেন এবং বছরে ৭টি খুন করলেও তার কিছু হবে না এবং ইসলামপুর, বেগমবাদ পরগনা তার জমিদারির অধীনে থাকবে।  পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজে এ অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনার জন্য কোটা পদ্ধতির ঘোষণা দেন ব্রিটিশ সরকার।

বাংলা ১৩৩৮ সাল পর্যন্ত জমিদার রামানন্দ সিংহ রায়ের জমিদারি তার নামেই থাকে। তারপর তার জমিদারি সমান দুই অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রথমটি ইসলামপুর পরগনা (বর্তমানে পাবনা) এবং দ্বিতীয়টি বেগমাবাদ (বাস্তভিটা)। এক ভাগ পায় জমিদার রামানন্দ সিংহ রায়ের বড় মেয়ে প্যারী সুন্দরী এবং আরেক ভাগ পায় তার ছোট মেয়ে শ্যামা সুন্দরী।

শ্যামা তার ইসলামপুর পরগনা জমিদারি চালাতে থাকেন। শ্যামা সুন্দরীর ৩টি ছেলে ছিলো। বড় ছেলে সুরেন্দ্র নারায়ন সিংহ, মেজ ছেলে সমোরেন্দ্র নারায়ন সিংহ এবং ছোট ছেলে ব্রজেন্দ্র নারায়ন সিংহ। তাদের মায়ের মৃত্যুর পর তারা জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সর্বশেষে সমোরেন্দ্র নারায়ন সিংহের নাতি দেবেন্দ্র নারায়ন সিংহ, সুরেন্দ্র নারায়ন সিংহের নাতি মেজেন্দ্র নারায়ন সিংহ জমিদারের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা ১৩৫৩ সাল পর্যন্ত তারা জমিদারি ধরে রাখেন।

পরবর্তী সময়ে শ্যামা সুন্দরীর সব সম্পত্তি ঋণের দায়ে নিলামে উঠে এবং সেই সম্পত্তি তাদের কাছ থেকে ক্রয় করেন রতন মোহন বন্দোপাধ্যায়। কিন্তু রতন মোহন বন্দোপাধ্যায়ও এ সম্পত্তি বেশি দিন রাখতে পারেননি। তিন বছর পর তিনি এ সম্পত্তি বিক্রি করে দেন শিব চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের কাছে। শুরু হয় শিব চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের জমিদারি। কিন্তু তার এ জমিদারিও বেশি দিন স্থায়ীত্ব লাভ করতে পারেনি। কয়েক বছর যেতে না যেতেই তার এ সম্পত্তি সরকার নিলামে তোলে। নিলামে মোট সম্পত্তির এক ভাগের মালিক হন শিব চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের দুই ছেলে মৃণালিনি বন্দোপাধ্যায় ও কৃষ্ণ কমল বন্দোপাধ্যায়। আর অন্য এক ভাগের মালিক হন মোজাম্মেল হক চৌধুরী, গণি চৌধুরী, হক চৌধুরী, মেজবা চৌধুরী, মোশারফ হক চৌধুরী।

এসময় শ্যামা সুন্দরীর পরিবারের সবাই ভারত চলে যান। আর এ অঞ্চলে জমিদার রামানন্দ সিংহ রায়ের পর তার সম্পত্তির এক অংশ নিয়ে জমিদারি শুরু করেন তার বড় মেয়ে প্যারী সুন্দরী। আর এভাবেই বাংলা ১৩৬০ সাল পর্যন্ত চলে জমিদার রামানন্দ সিংহ রায় ও তার বংশধরদের জমিদারি। তারপর তারা স্বপরিবারে ভারতে চলে যান। তারপর তাদের সম্পত্তি নামে-বেনামে দখল হয়ে যায়। তাদের কোনো উত্তরসূরি আর এ দেশে নেই।

প্যারী সুন্দরী বাংলার নীল বিদ্রোহের অবিস্মরণীয় এক চরিত্র। স্বদেশ প্রেমের অনির্বাণ শিখাসম এক নাম। আজীবন লড়েছেন মাটি ও মানুষের পক্ষে, দেশমাতৃকার স্বার্থে। অত্যাচারী নীলকরের নীল কমিশনের সাক্ষ্যে বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাসলি ইডেন বলেছিলেন, ‘খুন, জখম, দাঙ্গা, ডাকাতি, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, মানুষ চুরি প্রভৃতি এমন কোনো অপরাধ নেই, যা নীলকরেরা করেনি।’

ব্রিটিশ কর্মকর্তা কেনির অত্যাচার ছিলো এদের চেয়েও মাত্রাতিরিক্ত। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান প্যারী সুন্দরী। কেনি ও প্যারী সুন্দরীর বিরোধের সূত্রপাত ভাড়ল-পোড়াদহ অঞ্চলের ধানের জমিতে জোরপূর্বক নীল চাষ করা নিয়ে। অত্যাচারে অতিষ্ঠ কৃষক, প্রজা, চাষিরা প্যারী সুন্দরীর কাছে দিনের পর দিন প্রতিকারের জন্য নালিশ জানান। তিনি নায়েব রামলোচনকে লাঠিয়াল বাহিনী নিয়োগ ও আক্রমণের পরামর্শ দেন। কেনির বাহিনীর কাছে তারা পরাজিত হন। ভাড়ল কুঠি লুণ্ঠিত হয়। কেনির অত্যাচার বৃদ্ধি পায়। এসময় পুনরায় প্যারী সুন্দরী নতুন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কেনির কুঠিতে আক্রমণ করে। কেনি কুঠিতে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। মিসেস কেনি অজস্র কাঁচা টাকা ছড়িয়ে দিয়ে প্যারীর লাঠিয়ালদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেন।

কেনি প্যারী সুন্দরীর বিরুদ্ধে কুঠি লুটের মামলা করেন। ভীত না হয়ে উল্টো, গর্ববোধ করেন প্যারী সুন্দরী। কেনির মাথার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন এবং মিসেস কেনিকে বালা পরিয়ে বাঙালি বধু সাজানোর অঙ্গীকার করেন। বিপরীতে সরে দাঁড়ায় ইংরেজ সরকার। পরের বছর কুষ্টিয়াকে দেয়া হয় মহকুমার মর্যাদা। শুধু নামে নয়, চিরকুমারী প্যারী সুন্দরী জীবন ও কর্মেও ছিলেন দেশপ্রেমের এক অনন্য প্রতীক।

বর্তমানে জমিদার ও প্রজাদরদী রামানন্দ সিংহ রায় ও তার কন্যা প্যারী সুন্দরীর বাস্তভিটার ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের সদরপুর গ্রামে কালের স্বাক্ষী হয়ে পড়ে আছে ব্রিটিশ নীল বিদ্রোহী ও ব্রিটিশ জমিদার রামানন্দ সিংহ রায়ের শেষ বসত বাড়ি। যুগের পরিবর্তনে ভেঙ্গে ফেলে লুটপাট করা হয়েছে জমিদার বাড়িটি। মাটির উপরে যেটুকু ছিলো, তা রাতের আঁধারে ভেঙ্গে নিয়ে গেছে এলাকাবাসী। জমিদারের জমিদারি তো অনেক আগেই শেষ হয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে বাড়ি ঘরও। তাদের ইতিহাস বিলুপ্তির পথে। তবুও যেহেতু রয়ে গেছে প্যারী সুন্দরীর এই বাস্তুভিটা, সেহেতু সেটি এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সংরক্ষণের দাবি।

সর্বশেষ

কুষ্টিয়ায় আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত ৭

কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলা নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার পর সংঘর্ষে জড়িয়ে অন্তত সাতজন...

কুষ্টিয়ায় শিক্ষার্থীকে শ্লীলতাহানি, বরখাস্ত প্রধান শিক্ষককে পুলিশে সোপর্দ

কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে পঞ্চম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে শ্লীলতাহানির মামলায় বরখাস্ত প্রধান শিক্ষককে বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর)...

কুষ্টিয়ায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২

কুষ্টিয়ায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় একটি শিশুসহ দু’জনের মৃত্যু হয়েছে।   বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) দুপুরের দিকে...

পাসপোর্ট সংশোধনে সরকারের নতুন নির্দেশনা

এনআইডির তথ্য অনুযায়ী পাসপোর্ট রি-ইস্যুর নির্দেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পাসপোর্ট...

আরও পড়ুন

টিউশনি করে গোল্ডেন এ প্লাস পেলেন কুষ্টিয়ার জমজ দুই বোন

সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা দীর্ঘদিন ধরে মানসিক রোগী। টিউশনি করে কোন রকমে সংসার চালাচ্ছেন...

ভারতীয় সিরিয়াল ‘সিআইডি’ দেখে কুষ্টিয়ার ফুল ব্যবসায়ী আবু তৈয়ব হত্যার পরিকল্পনা

কুষ্টিয়ার মিরপুরে ফুল ব্যবসায়ী আবু তৈয়ব (৫৪) হত্যার পর দ্রুততার সাথে রহস্য উদঘাটন করেছে...

কুষ্টিয়ার মিরপুরে র‌্যাবের অভিযানে ইয়াবাসহ আটক ২

কুষ্টিয়ার মিরপুরের কাতলামারী বাজার থেকে ইয়াবাসহ টুটুল হোসেন (২২) ও তৌফিক রানা সিয়াম (২০)...