রাজধানী ঢাকায় ক্যাসিনো বাণিজ্যসহ চাঁদাবাজি, টেনডারবাজির মতো নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে একে একে সব প্রভাবশালীদের নাম প্রকাশ পেয়েছে। এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম ও কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ।
তাদের সঙ্গে ঢাকার অপরাধ জগতের সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ভারাটে কিলারদের গভীর সম্পর্ক ছিল বলে অভিযোগ। এমনকি এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল দুবাইয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান।
সূত্রের তথ্য মতে, দীর্ঘদিন জিসানের নামে সরকারি দপ্তরের ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন জিকে শামীম। বিভিন্ন ব্যবসায়ও এই দুইজন ছিলেন পার্টনার। তবে সম্প্রতি যুবলীগ নেতারা জিকে শামীমকে কব্জা করে ফেললে দ্বন্দ্ব বাঁধে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের।
এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহচর শীর্ষসন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয় জিকে শামীম ও ঢাকা মহানগর যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় এক নেতার। এই সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত ছিলেন যুবলীগ নেতা খালেদ।
জানা যায়, বিরোধের একপর্যায়ে এদের ওপর ক্ষুব্ধ হন জিসান। এমনকি প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেন। এমন পরিস্থিতিতে জিসানের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে সিঙ্গাপুরে এক সমঝোতার বৈঠকের আয়োজন করেন খালেদ।
সূত্রের খবরে জানা গেছে, গত জুন মাসের মাঝামাঝি সিঙ্গাপুরে যান জিকে শামীম, মহানগর যুবলীগের ওই শীর্ষনেতা ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। জিসানও দুবাই থেকে সিঙ্গাপুরে যান। সিঙ্গাপুর শহরের মেরিনা বে’তে এলাকার একটি বিলাসবহুল হোটেলে তাদের বৈঠক হয়। তবে এই বৈঠকে কোনো সমঝোতাই হয়নি। পরে দেশে ফিরে আসেন জিকে শামীম ও যুবলীগের ওই শীর্ষনেতা।
সূত্র জানায়, জিসানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে দুই থেকে আড়াই বছর আগেই জিকে শামীমের নিয়ন্ত্রণে থাকা এই শীর্ষসন্ত্রাসীর অবৈধ আয়ের নানা ঘাট দখল করে নেন ঢাকা মহানগর যুবলীগের ওই শীর্ষনেতা। তার ছায়ায় জিসানের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে জিকে শামীমের। আবার শামীম ও যুবলীগের ওই নেতার ঘনিষ্ঠ ছিলেন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।
তবে সম্প্রতি জিসানের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন যুবলীগ নেতা খালেদ। যুবলীগের শীর্ষনেতা ও শামীমের সঙ্গে জিসানের পুরনো দ্বন্দ্ব মেটানোর দায়িত্বও নেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় বসে সিঙ্গাপুরের ওই বৈঠক।
জানা গেছে, বৈঠককালে জিসান টাকার হিসাব চান জিকে শামীম ও যুবলীগের শীর্ষ ওই নেতার কাছে। এ নিয়ে কোনো সমঝোতা না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শীর্ষসন্ত্রাসী জিসান।
এ বৈঠকের কয়েকদিন পর গত ২৬ জুলাই রাতে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার একটি বাসা থেকে বিদেশি অস্ত্র, গুলিসহ গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন জিসানের ২ সহযোগীসহ ৩ জন।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- খান মোহাম্মদ ফয়সাল (৩৮), জিয়াউল আবেদীন ওরফে জুয়েল (৪৫) ও মো. জাহিদ আল আবেদিন ওরফে রুবেল (৪০)। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি একে ২২ রাইফেল, চারটি বিদেশি পিস্তল, একটি বিদেশি রিভলবার ও ৪৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। অটোমেটেড একে ২২ রাইফেলটি আমেরিকায় তৈরি বলেও জানা যায়।
তাদের গ্রেপ্তারের পর ডিবি পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে দুজন শীর্ষসন্ত্রাসী জিসানের সহযোগী। তারা দুবাই থেকে একটি বিশেষ কিলিং মিশনে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছে। সূত্রমতে, ডিবি পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও গ্রেপ্তারকৃতরা তুলে ধরেছে জিসানের হত্যা পরিকল্পনার তথ্য।
এদিকে গত ১৮ সেপ্টেম্বর র্যাবের ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের মুখে গ্রেপ্তার হন ইয়ংমেনস ক্লাবের মালিক ও পরিচালক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরপর ২০ সেপ্টেম্বর অস্ত্র ও দেহরক্ষীসহ গ্রেপ্তার হন জিকে শামীম। গ্রেপ্তারের পর দুইজনকেই আদালতের নির্দেশনায় রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ডে ভয়ঙ্কর সব তথ্যও দিয়েছেন তারা। যা আতকে উঠার মতো।
তাদের তথ্যে বেরিয়ে এসেছে আরও অনেক রাঘব বোয়ালদের নামও। এছাড়া গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জিকে শামীম জিসানের আক্রমণের তথ্যও দিয়েছেন। মূলত জিসানের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হওয়ার পর থেকে তার আক্রমণ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতেই নিরাপত্তা টিম গঠন করেন।
তাদের দেওয়া তথ্য ও নানা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রায় ২৩ সদস্যের প্রভাবশালীদের একটা তালিকাও করা হয়েছে। তবে এরই মধ্যে এসব প্রভাবশালীদের অনেকেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
জানা গেছে, এক সময় ঢাকার অপরাধজগত কাঁপানো শীর্ষসন্ত্রাসীদের কেউ এখন বিদেশে, কেউবা কারাগারে। তালিকভুক্ত ২৩ শীর্ষসন্ত্রাসীর মধ্যে অন্যতম জিসান অনেক বছর ধরেই দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই ঢাকার অপরাধজগতে নিজের আধিপত্য বজায় রাখছেন এই শীর্ষসন্ত্রাসী। যথারীতি তার হুকুমে চলছে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি।
সরকারের দুর্নীতিবিরোধী চলমান অভিযানে গ্রেপ্তার তালিকায় আরও রাঘববোয়াল রয়েছেন। যাদের অপরাধজগতের সঙ্গে গভীর কানেকশন আছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এমন প্রেক্ষাপটে চলমান অভিযান ঢাকার অপরাধজগতে (আন্ডারওয়ার্ল্ড) নতুন এক সমীকরণের বার্তা দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, পুরো বিষয়টির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।