যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট এক সিদ্ধান্তে জানিয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ছয়টি মুসলিম-প্রধান দেশ থেকে ভ্রমণেচ্ছুদের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জারি করেছিলেন; তা আইন সম্মত। প্রেসিডেন্ট হিসেবে এমন নিষেধাজ্ঞা জারির নির্বাহী ক্ষমতা তাঁর রয়েছে।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প প্রথম এই নিষেধাজ্ঞার কথা বলেছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই এক নির্বাহী আদেশে তিনি এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেন। অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে একাধিক ফেডারেল আদালত এই রায় মুসলিম-বিদ্বেষী হওয়ার কারণে তার কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ প্রদান করে। আদালতের আপত্তির মুখে ট্রাম্প তাঁর নির্দেশ তিনবার সংশোধন করেন।
তৃতীয়বারের মতো যে আদেশ তিনি জারি করেন তাতে সিরিয়া, লিবিয়া, ইরান, ইয়েমেন, চাদ ও সোমালিয়া—এই ছয় মুসলিম-প্রধান দেশ ছাড়াও উত্তর কোরিয়া ও ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পরে চাদকে এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। বুধবার মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্পের এই সংশোধিত তৃতীয় নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার পক্ষে রায় ঘোষণা করল।
হোয়াইট হাউস এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, জাতীয় নিরাপত্তার যে যুক্তি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বরাবর দিয়েছেন, আদালত সেই যুক্তি মেনে নিয়েছে। এটি তাঁর গৃহীত নীতির জয়। রক্ষণশীল রাজনীতিক ও ভাষ্যকারেরাও একে স্বাগত জানিয়েছেন। অন্যদিকে উদারনৈতিক মহল আদালতের রায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের চোখে, নয় সদস্য বিশিষ্ট আদালত এখন খোলামেলাভাবে ‘ডানপন্থী’।
সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম বিচারক সোনিয়া সতোমাইয়ারের ‘ভিন্নমত’ ভাষ্যে এই উদ্বেগ স্পষ্ট হয়েছে। তিনি ট্রাম্পের নাম উল্লেখ করে বলেন, নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প একাধিকবার মুসলিমদের নাম উচ্চারণ করে তাঁদের যুক্তরাষ্ট্রে আগমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দাবি করেছেন। সেই লোকই এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তিনি রায়ে লেখেন—‘এক মুহূর্তের জন্য ব্যাপারটি নিয়ে ভাবুন, তাহলে এটা কতটা ক্ষতিকর তা আপনারা উপলব্ধি করতে পারবেন।’
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে যারা মামলা দায়ের করে, তাদের অন্যতম ছিল হাওয়াই অঙ্গরাজ্য। এই রাজ্যের কৌঁসুলি নীল কাতিয়াল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাঁর হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, এই রায় মার্কিন মূল্যবোধ-বিরোধী। তিনি এই বিদ্বেষমূলক ও ক্ষতিকর এই রায় সংশোধনের জন্য মার্কিন কংগ্রেসের কাছে আবেদন রাখেন। তবে সে আবেদন যে রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত চলতি কংগ্রেসের কানে ধরা দেবে না তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
উদারনৈতিক ভাষ্যকারেরা মনে করেন, আদালতের এই রায় অভিবাসন প্রশ্নে ট্রাম্প যে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন, তা উসকে দেবে। ওয়াশিংটন পোস্টের ডেভিড নাকামুরা লিখেছেন, কংগ্রেসকে এড়িয়ে শুধু নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে একের পর এক অভিবাসন-বিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণে ট্রাম্প এখন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন।
একই কথা মনে করেন আটলান্টিক পত্রিকার এডাম সারোয়ের। এক মন্তব্য প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ যে মুসলিম-বিদ্বেষী, এই সত্য উপেক্ষা করার যে সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্ট নিল, তা আরও নতুন নতুন বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ট্রাম্পকে উৎসাহী করবে। আদালতই তাঁকে সে দরজা খুলে দিল।
হাওয়াইয়ের ডেমোক্র্যাট সিনেটর মাজি হিরোনা প্রশ্ন রেখেছেন, ‘তাহলে এরপর কার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হবে? মেক্সিকো, হন্ডুরাস বা গুয়াতেমালার নাগরিক? নাকি অন্য কেউ?’
আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন ও বিভিন্ন মুসলিম সংস্থার একাধিক মুখপাত্রও এই রায়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, এই নির্দেশ শুধু মার্কিন মূল্যবোধের পরিপন্থী নয়, তা এই দেশের শাসনতন্ত্রেরও পরিপন্থী। আমেরিকা বরাবর শুধু বহিরাগতদের প্রতি সমর্থন ও আশ্রয়ের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তাই নয়; বিশ্বজুড়ে ধর্ম-ভিত্তিক বৈষম্যের প্রতিবাদ করেছে। ওয়াশিংটন পোস্ট একজন মার্কিন মুসলিমের কথা উদ্ধৃত করে লিখেছে, ‘এই দেশটিকে এখন আর আমার দেশ মনে হয় না।’