বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আনুষ্ঠানিক রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল কুষ্টিয়া থেকে। ১৯৪৪ সালে কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় নিখিল বঙ্গ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন। সে সম্মেলনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন। ওই বছরেই তিনি এ সংগঠনের বৃহত্তর ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
বিখ্যাত আইনজীবী, বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর কুষ্টিয়ার কৃতী সন্তান ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। তিনি ওই সম্মেলনের স্মৃতিচারণ করে জানান, শ্রদ্ধেয় ‘মুজিব ভাই’ ১৯৪৪ সালে কুষ্টিয়ায় এলেন। তখন ছাত্রলীগ ‘নিখিল বঙ্গ ছাত্রলীগ’ ছিল। কুষ্টিয়ায় এর সম্মেলন হবে। তখন সেক্রেটারি শাহ আজিজুর রহমান। তার পিতা একজন মাওলানা, নদীয়ার কৃষ্ণনগরের, তাদের কুষ্টিয়ায় খুব দখল ছিল।
কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়ায় অবস্থিত পরিমল থিয়েটার হলে ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়। সম্মেলনকে ঘিরে শহরে উত্তেজনা বিরাজ করে। সম্মেলনে দুটি প্যানেলের একটি শাহ আজিজুর রহমান, অন্যটিকে বঙ্গবন্ধু সমর্থন দিয়েছেন। তার প্যানেলে ওয়াসিক-নুরুদ্দিন নির্বাচন করেন। বেশ দাপুটে নুরুদ্দিন বরিশালের লোক। দুই প্যানেল, পুরো শহর ও হলরুমে টানটান উত্তেজনা। ডেলিগেটস বেশি না হলেও পরিমল হল অ-ছাত্রে ভরে গেছে। সেই মুহূর্তে শৈলকুপার নির্বাচিত এমএনএ শিক্ষক সমিতির সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট কামরুজ্জামান সাহেব পরিমল হলে এলেন। তিনি হলের ভেতরে গেলেন না, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ব্যালকনিতে চলে গেলেন। সেই সঙ্গে আমরাও। সেখানেই প্রথম মুজিব ভাইকে দেখলাম, পাতলা, লিকলিকে, লম্বা, সুদর্শন এক তরুণ।
কামরুজ্জামান জোরে বললেন, ‘যারা নিচে বসে আছে, কেউ ডেলিগেটস নয়, বাইরের লোক; তাদের বের করে দেওয়া হোক।’ আমরাও সঙ্গে সঙ্গে স্লোগান তুললাম, ‘তাদের বের করে দেওয়া হোক।’ শহরে তখন টানটান উত্তেজনা, তখন কথায় কথায় কুষ্টিয়ায় ছুরি চালাচালি হতো। এমন এক অবস্থায় তরুণ ছাত্রনেতা মুজিব ভাই মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এই অছাত্রদের নিয়ে এসে ডেলিগেটস নয় এমন লোকদের নিয়ে যে সম্মেলন করছেন, তা সঠিক নয়; এটি ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ীও নয়।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও অন্যান্য ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৪১ সালে অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পরীক্ষা প্রত্যাশা অনুযায়ী না হওয়া সত্ত্বেও তিনি দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেছিলেন। পরীক্ষার পরপরই তিনি কলকাতায় যান। তখন পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। চল্লিশের দশকে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়, সেই আন্দোলনের সঙ্গে তরুণ শেখ মুজিব নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। যোগ দেন মুসলিম লীগ আর মুসলিম ছাত্রলীগে। এ সময় মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন এবং সংগঠন সৃষ্টির তালিম নেন।
কুষ্টিয়ার সম্মেলন থেকে বের হয়েই তিনি অছাত্রদের বাদ দিয়ে শুধু ছাত্রদের নিয়ে ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার জোর কাজ শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় স্থির করা হয় একটি ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হবে, যার নাম হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। গঠিত হলো পাকিস্তানের প্রথম ছাত্রসংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’, পরবর্তী সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। প্রথম আহ্বায়ক করা হয় নইমউদ্দিন আহমদকে। কিন্তু বাস্তবে এই ছাত্রসংগঠনটি সৃষ্টি ও তাকে গড়ে তোলার একক কৃতিত্ব শেখ মুজিবের। নেতৃত্বের গতিশীলতার কারণে ছাত্রলীগ দ্রুত সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন থেকে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে সকল আন্দোলন সংগ্রামে জাতির জনকের অংশগ্রহণ অবধারিত ছিল।
১৯৪৯ সালে ঢাকায় ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন হলো শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে। নতুন কমিটি হলো। সেই কাউন্সিলে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সভ্য থাকব না। ছাত্রপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকার আর আমার কোনো অধিকার নেই। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কারণ আমি ছাত্র নই।’ ওই বছরের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি সে সংগঠনের হাল ধরেন।
রাজনীতির এই প্রবাদপুরুষ আনুষ্ঠানিকভাবে নেতৃত্বের শুরু করেছিলেন কুষ্টিয়া থেকে। পরিমল থিয়েটার নামে যে নাট্যশালায় তিনি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন, সেখানে এখন বহুতলা আধুনিক শপিং সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন আছেন, যারা ওই সময়ের সাক্ষী। সুত্র- খোলা কাগজ