দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মিঠাপানির অন্যতম উৎস গড়াই নদী। এমনকি সুন্দরবনে মিঠাপানির চাহিদার একটি অংশ মেটায় গড়াই। তবে দুই দফা খনন কাজ করেও দীর্ঘমেয়াদি কোনো ফল আসেনি। বরং নদীর বর্তমান চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে খনন কাজ হয়েছে। নদীতে পলি পড়ে প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ হেঁটে এমনকি সাইকেল চালিয়ে গড়াই পার হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে খানাখন্দে কিছু পানি আটকে আছে। বার বার খননে কাংখিত ফল না পাওয়ায় নদীপাড়ের মানুষের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। নদীতে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশি মাছ বিলুপ্তির পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে।
তাই তৃতীয় দফায় সুন্দরবন রক্ষায় ৫৯০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ৪ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে ৩৭ কিলোমিটার নদী খনন ও ৭ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ করা হবে। চলতি অর্থ বছরে কাজ শুরু হবে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিপুর ও মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা থেকে গড়াইয়ের উৎসমুখ শুরু হয়েছে। নদীটি কুষ্টিয়া ছাড়াও মাগুরা, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, যশোর ও খুলনা হয়ে সুন্দরবনে গিয়ে মিশেছে। সুন্দরবন ছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নোনা পানির আগ্রাসন রুখতে বড় ভূমিকা রাখে গড়াইয়ের মিঠাপানি।
জানা যায়, সুন্দরবনসহ জীববৈচিত্র রক্ষায় গড়াই খনন প্রকল্প নেয়া হয় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। এরপর ২০০৯ সালের পর দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠন করার পর ফের দ্বিতীয় দফা গড়াই খনন প্রকল্পে শতকোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্পটি বছর খানেক আগে শেষ হয়। এরপরও পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশীয় অর্থায়নে মেইনটেইনিং কাজ চালিয়ে নদীকে সচল রাখার চেষ্টা করছে। তবে খননে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি হওয়ায় এ নিয়ে বিগত সময়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সঠিক গবেষণা, অপরিকল্পিত ড্রেজিং, কাজ বাস্তবায়নে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে গড়াই খননে সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। সন্দুরবনকে রক্ষা ও নোনাপানির আগ্রাসন রুখতে সারাবছর মিঠাপানির প্রবাহ সচল রাখতে প্রকল্পটি নেয়া হলেও দৃশ্যত তেমন কোনো ফল মিলছে না বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতেও গড়াই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সুন্দরবনের জন্য গড়াইয়ের মিঠাপানি অপরিহার্য।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমে গড়াই নদীর দুই কূল পানিতে উপচে পড়লেও শুস্ক মৌসুমে নদীর চেহারা একেবারেই ভিন্ন। খনন কাজ চলার পরও শুস্ক মৌসুম এলে দেখা যায় পানি শুকিয়ে প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে নদীর অবস্থা একেবারেই করুণ। নদীর কুমারখালী-যদুবয়রা ঘাট এলাকার ভাটিতে গিয়ে দেখা গেছে নদী শুকিয়ে গেছে। কোনো স্রোত বা প্রবাহ নেই। এখানে মানুষ হেঁটেই নদী পার হচ্ছে। মটর সাইকেল চালিয়েও নদী পার হচ্ছে অনেকে। খাদে সামান্য পানি জমে আছে। সেখানে গোসলসহ কাপড় ধোয়ার কাজ করছে স্থানীয়রা। স্থানীয় বাসিন্দা এনামুল হোসেন বলেন, খননের পরও নদীতে পানি নেই। জায়গায় জায়গায় কিছু পানি জমে আছে। বালু পড়ে শুকিয়ে গেছে। কুমারখালীর নন্দলালপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান স্থানীয় এলংগি গ্রামের নদী পাড়ের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, নদী খনন করে সেই বালু আবার নদী পাড়েই ফেলা হচ্ছে, ফলে বর্ষা মওসুমে সেই বালু পুনরায় নদীতে চলে আসে। যার ফলে খননে কোন সফলতা হয় না। তিনি বেড়ি বাঁধের বাইরে অথবা নির্দিষ্ট স্থানে বালু জমা করার পরামর্শ দেন। চর আগ্রাকুন্ড গ্রামের হাসিনা খাতুন বলেন, পানির খুব সমস্যা। নদী পাড়ে যারা বসবাস করে তারা বেশি সমস্যায় ভুগছে। চাপকলে পানি ওঠে না। আবার নদীতেও পানি নেই। যা আছে তাতে গন্ধ।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পীযূষ কৃষ্ণ কুন্ডু বলেন, একনেকে প্রকল্প পাস হয়েছে। টেন্ডারের প্রক্রিয়া শেষে এ বছরেই কাজ শুরু হবে। তবে অতীতে এ কাজ নিয়ে নানা অনিয়মের বিষয়টি সামনে আসায় এবার প্রকল্পে স্বচ্ছতার বিষয়ে জোর দেয়া হবে। আর মানুষ যাতে দীর্ঘমেয়াদি সুফল পায় সে ব্যাপারে জোর দেয়া হচ্ছে। কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন বলেন, গড়াই কুষ্টিয়াসহ আশপাশের জেলার লাইফলাইন। এটি সচল রাখতে সরকার ৫৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। অচিরেই খনন কাজ শুরু হবে। তবে এবার খননের মান যাতে ভালো হয় সে ব্যাপারে মনিটরিং জোরদার করা হবে। কোনো অনিয়ম হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।