লেখক: ওয়াহেদ সবুজ
এই মুহূর্তে মারুফের পরনে সাদা শার্ট, নীল জিন্স, কালো সু, হাতে দামি ঘড়ি; দু আঙুলে ধরে রাখা একটি টকটকে লাল গোলাপ, শার্টের উপরেরখোলা বোতামের নিচে বুকের লোম উড়ছে বাতাসে৷ খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে আছে তাহিয়ার দিকে; না, সম্ভবত তাহিয়ার মা মনামী ফেরদৌসের দিকে; না না, দুজনের দিকেই বোধহয়৷
গত মাস চারেক ধরে দারুণ এক ঘোরের মধ্যে আনন্দের উত্তেজনা নিয়ে সময় কাটছে তাহিয়ার৷ তার মায়ের মতে ‘কোনো রকম চালিয়ে নেয়ার মতো চেহারা’ নিয়ে কোনোদিনই তেমন একটা উচ্ছ্বাস ছিলো না তার৷ তবে একটু হালকা সাজে তাকে ভালোই লাগে; ভালোই লাগে মানে, ‘চালিয়ে নেয়ার মতো’র চাইতে অন্তত কয়েকগুণ বেশিই ভালো লাগে! স্বভাবে বড্ড লাজুক ও কিছুটা ভীতু প্রকৃতির; স্কুলজীবনে স্কুল-কোচিং-টিউশান সব জায়গায় সে মায়ের হাত ধরে হেঁটেছে, কলেজে ওঠার পর খানিকটা বিপাকে৷ বিপাকে এ কারণে যে প্রথমত মায়ের সাথে কলেজে যাওয়া খুব একটা হাস্যকর ব্যাপার, দ্বিতীয়ত একা একা কোথাও যেতে, এমনকি রাস্তায় হাঁটতেও তার ভয় লাগে৷ তার মনে হয়, রাস্তায় চলাচলকারী প্রত্যেকটা মানুষের নজর তার দিকে; বেশিরভাগ সময় সেই দৃষ্টিতে সে ক্ষুধা-তৃষ্ণা দেখতে পায়৷
শেষমেষ একজন ক্লাসমেট জোটাতে পেরেছে যার সাথে সে কলেজে আসা-যাওয়া করে এবং কলেজের পুরোটা সময়, তা সে ক্লাসরুমে হোক বা পুকুরধারে বা লাইব্রেরিতে, মীরা মেয়েটি সব সময় তার সাথে; ভুল বলা হলো, আসলে সে-ই মীরার গা ঘেঁষে ঘুরে বেড়ায় পুরোটা সময়৷ কোনো সময়ই যে তাহিয়া একা থাকে না, তা না; কখনো-সখনো যখন মীরা তার ছেলেবন্ধুর সাথে লাইব্রেরির পেছনের নির্জন জায়গাটায় গিয়ে বসে, তখন সে লাইব্রেরির সিঁড়িতে একাই বসে থাকে৷ লাইব্রেরির ভেতরে বসে থাকলেও চলে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাবার পরেই এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় বলে সিঁড়িতে বসা৷
যাহোক, আমাদের তাহিয়া এখন একা একা বেশ চলতে পারে৷ এমনটা ঘটছে গত চার মাস ধরে৷ মারুফের সাথে প্রথম পরিচয়ের পরপরই সে বাংলাকবিতার মাহাত্ম্য বুঝতে পেরেছে! সুকান্তের ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতাটি যে কী ভীষণ রকম সত্য, কী ভীষণ রকম বাস্তব— রীতিমতো অভিভূত সে! প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটা ঘটার পর থেকে কিছুদিন মারুফের মধ্যে সে সুকান্তকে কল্পনা করত! মারুফ যখন এসে বললো, “তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে৷” কী দারুণ ভয় সে পেয়েছিল সেদিন! রিকশায় তার পাশে মীরা বসে, রিকশাওয়ালা হকচকিয়ে গেছে৷ ভয় ভয় কণ্ঠে তাহিয়া ছোট্ট করে বললো, “বলুন৷” মারুফ বললো, “এভাবে না, আলাদাভাবে৷” এবারে রীতিমতো চিৎকারের আওয়াজে সে বললো, “যা বলার এদের সামনেই বলুন; আমি যেতে পারবো না৷” প্রায় সাথে সাথে মারুফও গলায় জোর লাগিয়ে বলে ফেললো, “তুমি যে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার দিকে তাকাও, আমাকে দেখার চেষ্টা করো, সেটা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছি!” তাহিয়া লজ্জায় প্রায় মাটিতে মিশে যায়; মারুফ বলতে থাকলো, “আসলে, আমিও তো তোমার পেছনে পেছনে, তুমি যেখানে যেখানে যাও সেখানেই পৌঁছে যাই৷ আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো৷ আমিও!” এ কথা শুনে মীরার চোখ কপাল ভেদ করে আকাশে পাড়ি দেবার উপক্রম— বলে কী এ ছেলে; তাহিয়া?!!
তাহিয়া যে লুকিয়ে লুকিয়ে মারুফকে দেখতো, এটা তো খাঁটি কথা; কোনো ভুল নেই! মারুফকে তো সেই স্কুলজীবন থেকেই তার ভালো লাগে৷ নবম শ্রেণিতে কোচিং এ পড়তে গিয়ে মারুফকে সে প্রথম দেখেছে৷ এতদিনে ভালোলাগার গল্পগুলো তার বুকের ভেতর একটা এভারেস্ট গেড়ে বসেছে! মারুফের কথাগুলো শোনার পর থেকে তাহিয়ার জীবনে এসেছে এক অভাবনীয় পরিবর্তন৷ সে লক্ষ করতে থাকলো, সে ধীরে ধীরে মিথ্যা বলা শিখছে; একা একা এখানে-সেখানে অনায়াসে হাঁটাহাঁটি করছে, কিন্তু তার একবারের জন্যও মনে হচ্ছে না কেউ তার দিকে লোভাতুর দৃষ্টি ফেলছে৷ মাথার উপরে সমস্ত আকাশ হয়ে উঠেছে বরফ-বাগান, পায়ের নিচে মাটিগুলো সুগন্ধি চন্দন; গাছের পাতায় নেচে ওঠে আনন্দ, কলেজপুকুরের জলতরঙ্গে ভেসে বেড়ায় লাল-নীল স্বাধীন স্বপ্ন!
২.
পুরো ব্যাপারটি স্বপ্নের মতো করে ঘটতে থাকলো; আঙুলে আঙুল রেখে হাঁটাহাঁটি, রাস্তায় পাশে দাঁড়িয়ে চটপটি-ফুচকা, লাইব্রেরির পেছনটাতে মীরাদের স্থানটি দখল করে ফেলা! মারুফের এইচএসসি নাকের ডগায়, তাহিয়ার ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল; এগুলোকে সামনে রেখে বইপত্র শিকেয় তুলে মাস চারেকের তুখোড় প্রিপারেশান, অবশ্যই পরীক্ষার প্রিপারেশান নয়! মাসখানেক না পেরোতেই কানে ফোন ঠোঁটে ‘এই শোনো’ অবস্থায় তাহিয়া গ্রেফতার মায়ের সতর্ক চোখে!
মনামী ফেরদৌস বেশ কিছুদিন হলো মেয়ের মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ করছেন৷ আগে যেখানে কলেজে থাকতে তার ভালো লাগতো না, কখনো কখনো ক্লাস মিস দিয়ে হলেও তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসতো, সেখানে গত কিছুদিন কলেজে সে দারুণ মনোযোগী হয়ে উঠেছে; এখন আর কলেজে যাবার আগে মীরাকে ফোন করার প্রয়োজন পড়ে না; বিশেষ করে মোবাইলের স্ক্রিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা মেয়ের চোখ তাঁকে অপ্রিয় কিছুর ইঙ্গিত করছিল! তাই গত কয়েকদিন তিনি কিছুটা সতর্ক!
মায়ের কাছে ধরা পড়ার পর তাহিয়া মারুফকে বাসায় এনে হাজির করলো; দুজনের মুখে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা শুনে মনামী আশ্বস্ত হলেন, বুকের উপর থেকে যেন পাথর নেমে গেল; তিনি মনে মনে ভীষণ সন্তুষ্ট হলেন, কারণ তাঁর এত সতর্ক যত্নে বেড়ে ওঠা মেয়ে কোনোভাবেই বিপথে যেতে পারে না— এ বিশ্বাসটা এ যাত্রায় টিকে গেছে! তাছাড়া এত ভালো একটা ছেলের সাথে তাঁর মেয়ের বন্ধুত্ব হয়েছে— এটাও একটা ভালো খবর; দিনকাল যা পড়েছে, একটা ছেলে বন্ধু থাকলে অনেক দিক থেকে সেইফ থাকা যায়৷ এ সব মিলিয়ে তাহিয়ার মায়ের কাছে মারুফের একটি গ্রহণযোগ্যতার জায়গা তৈরি হলো খুব অল্প সময়ের মধ্যেই; পরস্পরের বাড়িতে আসা-যাওয়াটাও নির্বিঘ্ন হয়ে উঠলো নিমিষেই৷
মারুফকে মনামী ফেরদৌসের বেশ ভালো লাগে; স্মার্ট ছেলে, সদা হাস্যোচ্ছল, মুগ্ধকর বাচনভঙ্গি, কথা বলায় ওস্তাদ! প্রায়ই তিনি তাহিয়ার হাত দিয়ে এটা-ওটা রান্না করে পাঠান; তাহিয়া যেন নিরাপদে থাকে, সে বিবেচনায় মারুফের সাথেই যাতে মেয়ে বাসায় ফেরে সেটাও তিনি নিশ্চিত করেছেন; তাঁর মূল্যায়নে মারুফ নিরাপদ এবং নিঃসন্দেহে এপ্রিশিয়েবল৷ প্রতিদিন সকালে ও রাতে অন্তত দুবার তিনি ফোন করে ছেলেটার খোঁজ নেন৷ সব মিলিয়ে, অত্যন্ত প্রত্যাশিত পারিবারিক বলয় তৈরি হলো যেখানে কারো মধ্যে কোনো খারাপ লাগা নেই, গোমরামুখিতা নেই, এবং অতি অবশ্যই পরীক্ষা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তাও নেই৷
সপ্তাহ দুয়েক হলো মারুফের সাথে একটু ঘনঘনই কথা কাটাকাটি চলছে৷ খুব বড় কোনো ভুল বোঝাবুঝি নয়; বেশিরভাগ সময়েই ফোন করলে কেন ‘ওয়েটিং’ দেখাচ্ছে— এটা হচ্ছে তাহিয়ার রাগের প্রধান কারণ, দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে প্রায় দিনেই দেখা যাচ্ছে ব্যস্ততার বাহানা দেখিয়ে মারুফ তাকে একা একা রিকশায় তুলে দিচ্ছে৷ হঠাৎ করে এ ধরনের পরিবর্তন খুব একটা ভালো লাগছে না; যদিও রাগঝাল যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত তাহিয়াই আত্মসমর্পণ করে৷
সাদা শার্ট, নীল জিন্সে আর সব সময়ের মতো বোতাম খোলা বুকে মারুফকে আজ ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে; তাহিয়ার ইচ্ছে হলো একসাথে রিকশা করে ঘুরবে! কিন্তু আবারও সেই একই বাহানা— ব্যস্ততা; ফলাফল— আজকেও একইভাবে তাকে একা একা বাসায় ফিরতে হচ্ছে৷ যেতে যেতে হঠাৎ কী মনে হলো, কিছুদূর গিয়েই সে রিকশা থেকে নেমে পড়লো! যেখান থেকে মারুফ তাকে রিকশায় তুলে দিয়েছে, সেখানেই ফিরে গেল!
অবিশ্বাস্যভাবে তাহিয়াকে দেখে মারুফ হকচকিয়ে গেল; একবার তাহিয়া, আরেকবার তার মায়ের দিকে তাকায়! এই মুহূর্তে যে দুটো হাত লাল গোলাপটি স্পর্শ করে আছে, তার একটি মারুফের, অপরটি নিশ্চয়ই তাহিয়ার নয়; এমন একটি পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, মনামী সে সব কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না; লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে!
মীরার বলা কথাগুলো, যা কোনোভাবেই তাহিয়া বিশ্বাস করেনি, করেনি মানে করতে পারেনি, তার আই-উইটনেস এই মুহূর্তে সে নিজেই! মীরার কথাগুলো যতবার শুনেছে, ওকে পাগল বলেই মনে হয়েছে৷ তাহিয়ার মনে হয়েছে মীরার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার; মাথা খারাপ না হলে সে কীভাবে বলে যে মারুফ লুকিয়ে লুকিয়ে তার মায়ের সাথে দেখা করে; দেখা করতেই পারে, কিন্তু সে কীভাবে বলে যে তার মায়ের সাথে মারুফের যোগাযোগটা স্বাভাবিক নয়?
তিনজনের পারস্পরিক দৃষ্টিতে যে লুকোচুরি খেলা চলমান, তার মধ্যেই নীরবে গোলাপের একটি পাঁপড়ি ঝরে পড়লো; এই মুহূর্তে গোলাপটিই সবচেয়ে বেশি বিব্রত !