কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আইলচারা গ্রামের মিজানুর রহমানের স্ত্রী রিম্পা খাতুন গত ২৩ জুন বুধবার রাতে কুষ্টিয়া শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে সন্তানের জন্ম দেন। নবজাতকের ওজন হয় যথাক্রমে ১ কেজি ৭০০ গ্রাম। কম ওজন হওয়ায় নবজাতক গত বৃহস্পতিবার রাতে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
দিশেহারা হয়ে তারা কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের নবজাতক শিশুর বিশেষ সেবা ইউনিটে (স্ক্যানুতে) ভর্তি করে। সেখানে সেবা দিয়ে সুস্থ সবল করতে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের দোতলায় একটি কক্ষে এই ‘স্ক্যানু ইউনিট’ করা হয়েছে। নবজাতকের বাবা মিজানুর রহমানের বলেন, সন্তান জন্মের পর কম ওজন দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েন। পরে জানতে পারেন সদর হাসপাতালে তাদের সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। তাই দ্রুত সেখানে নিয়ে আসেন।
এখন তারা বেশ শঙ্কামুক্ত। স্ক্যানু ইউনিটের ইনচার্জ জ্যেষ্ঠ সেবিকা নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, এই ইউনিটে সময়ের আগে জন্ম নেওয়া ও কম ওজনের নবজাতকদের বিশেষ সেবা দেওয়া হয়। গত ২০১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৮ জুন এই ১৭ মাসে ১৫৬১ শিশু এখানে সেবা নিয়েছে। তার মধ্যে ১০৯৬ জন শিশু সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যায়, ৭৬ শিশু মারা গেছে। বাকি ৩৮৪ জন শিশুকে উন্নত চিকিৎসা জন্য রাজশাহী ও ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়েছে। ইউনিটের রেজিস্ট্রারের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ৮৪ শিশু সেবা নিয়েছে। এর মধ্যে এই হাসপাতালে জন্ম নেওয়া ৪১, বাকি ৪৩ শিশু কুষ্টিয়াসহ আশপাশের জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে এসেছিল। ৪ শিশু মারা যায়। ৫৪ জন এখন সুস্থ হয়ে বাড়িতে গেছে,২৬ জনকে উন্নত চিকিৎসা জন্য রাজশাহী ও ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করা হয়।
ফেব্রুয়ারি মাসে ৭৩ শিশু সেবা নিয়েছে। এর মধ্যে এই হাসপাতালে জন্ম নেওয়া ৩৮, বাকি ৩৫ শিশু কুষ্টিয়াসহ আশপাশের জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে এসেছিল। ৪ শিশু মারা যায়। ৪৭ জন এখন সুস্থ হয়ে বাড়িতে গেছে,২২জনকে উন্নত চিকিৎসা জন্য রাজশাহী ও ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করা হয়। মার্চ মাসে ৮৪ শিশু সেবা নিয়েছে। এর মধ্যে এই হাসপাতালে জন্ম নেওয়া২৯, বাকি ৫৫ শিশু কুষ্টিয়াসহ আশপাশের জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে এসেছিল। ৬শিশু মারা যায়। ৬৯ জন এখন সুস্থ হয়ে বাড়িতে গেছে ৯ জনকে উন্নত চিকিৎসা জন্য রাজশাহী ও ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করা হয়। এপ্রিল মাসে ৮৫ শিশু সেবা নিয়েছে। এর মধ্যে এই হাসপাতালে জন্ম নেওয়া ২৬, বাকি ৫৯ শিশু কুষ্টিয়াসহ আশপাশের জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে এসেছিল। ৮ শিশু মারা যায়।৭২ জন এখন সুস্থ হয়ে বাড়িতে গেছে, ৫ জনকে উন্নত চিকিৎসা জন্য রাজশাহী ও ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করা হয়। মে মাসে ৯৮ শিশু সেবা নিয়েছে। এর মধ্যে এই হাসপাতালে জন্ম নেওয়া ৩০, বাকি ৬৮ শিশু, জুন মাসে ৮৯ শিশু সেবা নিয়েছে। এর মধ্যে এই হাসপাতালে জন্ম নেওয়া ২৫, বাকি ৬৪ শিশু কুষ্টিয়াসহ আশপাশের জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে এসেছিল। ৩ শিশু মারা যায়।৭২ জন এখন সুস্থ হয়ে বাড়িতে গেছে, ১৪ জনকে উন্নত চিকিৎসা জন্য রাজশাহী ও ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করা হয়। বর্তমানে সেখানে জন্মগত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কম ওজনের ১১ শিশু ভর্তি আছে।
প্রতিদিনই ২-৩টা করে শিশু ভর্তি হতে আসে। হাসপাতাল সূত্র জানায়, ইউনিসেফের সহায়তায় ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ইউনিটের উদ্বোধন করেন কুষ্টিয়া-৩ সদর আসনের সাংসদ মাহবুব উল আলম হানিফ। উদ্বোধনের পর থেকেই এই ইউনিটে সেবা নিতে আসা নবজাতকের সংখ্যা বাড়ছে। সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে এই সেবা দেওয়া হচ্ছে। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের ৬ জন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও ৯ জন সেবিকা সার্বক্ষণিক এটার দেখভাল করেন। জানতে চাইলে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (শিশু) মো. আইয়ুব আলী বলেন, সময়ের আগে ও কম ওজনের জন্ম নেওয়া শিশুদের শরীরে তাপমাত্রাসহ জন্মগত বেশ কয়েকটি সমস্যা হয়। ওই ধরনের শিশুদের সুস্থ সবল করতে এই ইউনিটে নেওয়া হয়। এই ইউনিট হওয়ায় কুষ্টিয়াসহ আশপাশের কয়েকটি জেলার শিশুমৃত্যু হার কমে আসছে। এটার আরও প্রচার হওয়া প্রয়োজন।
সম্প্রতি হাসপাতালের দোতলার ওই ইউনিটে গিয়ে দেখা গেল, দরজার সামনে ‘সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ’ লেখা। চিকিৎসক ও দায়িত্বরত সেবিকা আর শিশুর একজন অভিভাবক ছাড়া অন্যরা প্রবেশ করতে পারে না। ইউনিটটি অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। জানালাগুলো কাচ দিয়ে ঢাকা। শব্দ ও দূষিত বাতাস থেকে মুক্ত রাখতে এই ব্যবস্থা। ইউনিটের দায়িত্বরত চিকিৎসক ও সেবিকা রয়েছে বিশেষ পোশাক। সেখানে প্রত্যেক নবজাতকের জন্য রয়েছে বিশেষ ধরনের ১২টি শয্যা। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা ও ফটোথেরাপি মেশিন রয়েছে।
শয্যার চারপাশে রয়েছে চিকিৎসা সেবার নানা যন্ত্র। চিকিৎসক নাসিমুল বারী নিজ খরচে এই ইউনিটে দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) ব্যবস্থা করেছেন। দেখে মনে হচ্ছে কোনো নামীদামি বেসরকারি হাসপাতালের পরিপাটি ওয়ার্ড। পুরো পরিবেশটি নীরব-নিস্তব্ধ। চিকিৎসক ও সেবিকারা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন নীরবে। সেবা নেওয়া নবজাতকেরা শূন্য থেকে ২৮ দিন বয়সী। ইউনিটের ইনচার্জ জ্যেষ্ঠ সেবিকা নিলুফা ইয়াসমিন জানান, ইউনিটের পাশের কক্ষে শিশুদের একজন অভিভাবক থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। দুধ খাওয়ানোর সময় মায়েদের এখানে আনা হয়। চিকিৎসকেরা জানান, মূলত পাঁচটি কারণে শিশুদের স্ক্যানুতে রাখার প্রয়োজন পড়ে। ওজন কম হয়ে জন্মলাভ করা, অপরিপূর্ণ অবস্থায় জন্মলাভ, জন্মের পর রোগাক্রান্ত হওয়া, জন্ম থেকে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া অথবা নিশ্বাস নিতে না পারা ও জন্ম থেকে জন্ডিসে আক্রান্ত শিশুদের স্ক্যানুতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এই ইউনিট পরিচালিত হয় ইউনিসেফের অর্থায়নে। গত ১৬ শে মে কুষ্টিয়া খোকসা থানার শ্যামপুর গ্রামের শিউলি আকতার কম ওজনের ছেলে শিশু জন্ম দেন। পরবর্তী সময় তাকে সরকারি হাসপাতালের এই ইউনিটে নেওয়া হয়। শিশুটিকে ১৩ দিন সেবা দেওয়ার পর সুস্থ সবল করে বাড়িতে পাঠানো হয়। শিউলি আকতারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাঁর ছেলে আগের তুলনায় এখন সুস্থ।