সাব রেজিষ্ট্রার সুব্রত কুমার সিংহ কুষ্টিয়ায় দুদকের জালে ঘুষের টাকাসহ আটক হন গত ৭ নভেম্বর। তার আটকের পর নিজ এলাকা মনিরামপুরের জয়পুর গ্রামসহ উপজেলার সর্বত্র আলোচনায় টক অফ দা টেনে পরিনত হয়েছে। একে একে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছ ঘুষের টাকায় গড়ে তোলা অবৈধ্য সম্পদের পাহাড়ের খোঁজ।
অবৈধ টাকা দিয়ে তিনি নিজ এলাকা যশোরের মনিরামপুরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় শত বিঘা জমি কিনেছেন। প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে মনিরামপুর পৌর শহরে নির্মান করেছেন আলিশান বাড়ি। এখানেই শেষ নয়। জমির পাশাপাশি তিনি রড সিমেন্টের বড় দোকান এবং মৎস্য খামারও করেছেন। আর অতিচালাক সুব্রত সিংহ এসব সম্পদ করেছেন নামে বেনামে।
অভিযোগ রয়েছে তার শ্বশুরবাড়ি ফরিদপুরেও সম্পত্তি করেছেন তিনি। এলাকায় অনুসন্ধানে তার অবৈধ টাকার সম্পদের পাহাড়ের তথ্য বেরিয়ে আসছে। অবশ্য আটকের পর দুদকের একটি টিম মনিরামপুরে অনুসন্ধানে নেমেছে তার অবৈধ সম্পদের খোঁজে।
অনুসন্ধানে জানাযায়, মনিরামপুর উপজেলার ঢাকুরিয়া ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামে সুব্রত কুমার সিংহের বাড়ি। বাবা দূগাপদ সিংহ ছিলেন জয়পুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। স্কুলে দূর্ণীতির দায়ে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। ফলে মনিরামপুরে একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলে তিনি কিছুদিন চাকুরি করেন। দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে সুব্রত সবার বড়। মধ্যবিত্ত পরিবারে অতিকষ্টে দূর্গাপদ সিংহ তার সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ময়মনসিংহে সুব্রত লেখাপড়া করত। লেখাপড়া শেষ করে একটি চাকুরি পান তিনি। তার পর বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৬ সালের প্রথম দিকে তিনি চাকুরি পান সাব-রেজিষ্ট্রারের। সাব-রেজিষ্ট্রারের চাকুরিটি তিনি আলাদিনের চেরাগের মত হাতে পান। খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, নড়াইলসহ কয়েকটি স্থানে চাকুরি করেন। বিশেষ করে দাকোপ বটিয়াঘাটাতে চাকুরির সময় তিনি সব চেয়ে বেশি ঘুষ বাণিজ্য করে অঢেল কালো টাকার মালিক হন।
২০০৮ সালে বর্তমান সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসিনের পর বিশেষ করে খান টিপু সুলতান তৃতীয় বার মনিরামপুর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার পর থেকে সুব্রত সিংহের দাপট কয়েকগুন বেড়ে যায়। সুব্রত সিংহের বাবা দূর্গাপদ সিংহ ছিলেন খান টিপু সুলতানের অত্যন্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি।
অভিযোগ রয়েছে ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সুব্রত সিংহ প্রভাব খাটিয়ে কোটি কোটি কালো টাকার মালিক হন। সুব্রত নিজ এলাকায় বাবার রাজনৈতিক ভিত শক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখতেন। এ সময়কাল তিনি তার নিজের গ্রাম জয়পুর এলাকায় যে সব জমি বিক্রি হয়েছে তার অধিকাংশ জমি বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে ক্রয় করেন। ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সুব্রতের বাবা ঢাকুরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। অবশ্য বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মাস দুয়েক আগে দূর্গাপদ সিংহ পরলোকগমন করেন।
এক সমিক্ষায় জানাযায়, জয়পুর এবং তার আশপাশ এলাকায় আসাদুজ্জামান, এরশাদ আলী, মোজাহার আলী, খোকা খা,আবু দাউদ, মুজিবুর রহমান, সমির সরদার, তৌহিদুল ইসলাম, মান্নান সরদার, যতিন সিংহ, সুধির সিংহ, দেবেন সিংহ, আবদুল জলিল, ইউসুফ আলী, দরবেশ কাশেম, হানিফা হোসেন, রজব আলী গাজী, ওয়াজেদ আলী, তরিকুল ইসলাম, শরৎ সিংহ, বিমল সিংহ, আবদুস সেলিম, সুনিল সিংহ, রনজিত সিংহ, কাশেম গাজী, সায়ফুল গাজী, তপন কুমারসহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে জমি কিনেছেন।
অভিযোগ রয়েছে এ ছাড়াও ফরিদপুরে তার শ্বশুর বাড়ি এলাকায় অনেক সম্পত্তি করেছে। খুলনা শহরে তার শ্বাশুড়ির নামে একটি দুইতলা বাড়ি কিনেছেন সুব্রত সিংহ। জয়পুর গ্রামে রয়েছে তার দুইতলা বাড়ি। পৌরশহরের ভগবানপাড়ায় জমি কিনে সেখানে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মান করেছেন চার তলা বিশিষ্ট ডাবল ফ্লাটের আলিশান বাড়ি।
পৌরশহরের ঘোষপাড়া, দোলখোলা, কলেজ মাঠেও সুব্রত জমি কিনেছেন। সব মিলিয়ে তিনি প্রায় শতাধিক বিঘার জমির মালিক হয়েছেন বলে জানাগেছে। এ ছাড়া পৌরশহরে গড়ে তুলেছেন রড সিমেন্টসহ দুইটি বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
পার্শ্ববর্তি হরিদাসকাটি ইউনিয়নের বাহাদুরপুরে রয়েছে তার বিশাল একটি মৎস্য খামার। আর এসব সম্পদের অধিকাংশ মালিকানা করেছেন স্ত্রী, বাবা, মা, ভাই, শ্বাশুড়িসহ বিভিন্ন নিকট আত্মিয়ের নামে। জয়পুর গ্রামের আবুল কালাম জানান, জমি কেনা সুব্রতের নেশায় পরিনত হয়েছে। ইমান আলী জানান, সুব্রতের কারনে এলাকায় জমির মূল্য দ্বিগুন হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে সুব্রতের ছোটভাই দেবাশীষ কুমার সিংহ বাদলের মালিকনাধিন মেসার্স সিংহ ট্রেডার্সে গেলে দোকানের এক কর্মচারী জানান, বাদল এক নেতাকে নিয়ে কুষ্টিয়া গেছে তার ভাইয়ের বাপারে তদ্বির করতে। তবে সুব্রত সিংহের কাকা মনিরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শুভাষ কুমার সিংহ জানান, যেভাবে অভিযোগ করা হচ্ছে বাস্তবে তা সঠিক নয়।
উল্লেখ্য সাব-রেজিষ্ট্রার সুব্রত কুমার সিংহ গত ৩ নভেম্বর কুষ্টিয়া সদরে যোগদান করেন। ৭ নভেম্বর অফিসের খাস কামরায় ঘুষ লেনদেনের সময় দুদকের জালে টাকাসহ ধরা পড়েন তিনি ও তার অফিস সহকারি রফিকুল ইসলাম। পরদিন কুষ্টিয়া সদর থানায় দুদক মামলা করে। সুব্রত বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা কারাগারে রয়েছেন। এ দিকে দুদকের একটি টিম ইতিমধ্যে মনিরামপুরে সুব্রতের অবৈধ সম্পদের খোজে নেমেছেন বলে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছেন।