প্রয়াত কণ্ঠ শিল্পী কুষ্টিয়ার (নদীয়া জেলা) মামুন নদীয়া ছিলেন এ প্রজন্মের একজন জনপ্রিয় বাউল কণ্ঠশিল্পী। তার গানের ছিল হাজারো ভক্ত। এখনও তার গান শ্রোতাদের কন্ঠে বেজে ওঠে মধুর সুরে। অল্প বয়সেই ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন। তিনি ২০০৭ ইং সালের ৩১শে মে ইন্তেকাল করেন। বাউল সম্রাট লালনের তীর্থ ভুমি কুষ্টিয়ার হাটশ হরিপুরে দরবেশ রেজন শাঁহ’য়ের মাজারে গুরু রেজন শাঁহ’র অন্যতম অনুসারী কন্ঠ শিল্পী মামুন নদীয়া।
মামুন নদীয়া ছিলেন বাংলারই এক নিভৃতচারী বাউল । সর্বদা ধবল রঙের গের“য়া পরতেন। চশমাপরিহিত মুখটি ছিল শ্যামল নিষ্পাপ । কথাবার্তার ভঙ্গিটি অত্যন্ত বিনীত । বড় নিঃশব্দে। তাঁর চলে যাওয়ার সময় দেশজুড়ে তেমন আলোরণ ওঠেনি । তিনি তো আর জাগতিক অর্থে ‘ধনী’ এবং ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তি ছিলেন না। মিডিয়া কখনও তাঁর পিছন পিছন দৌড়ায়নি, তাঁর খোঁজখবরও রাখেনি। তবে তাঁর স্বল্পকালীন জীবনটি পরিপূর্ণভাবে সার্থক হয়ে উঠেছিল । কেননা, জীবদ্দশায় তাঁর পরমের বোধ হয়েছিল।
এভাবে তাঁর জীবন সার্থক ও পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বাংলার মরমি দর্শন, যাকে আমরা বলি ‘ভাব’ – সেটি মামুন নদীয়া অত্যন্ত স্বচ্ছ ভাবে উপলব্দি করেছিলেন । তাঁর অবিস্মরণীয় ‘আমার মন না চায় এ ঘর বাঁধি লো কিশোরী’ গানটিই তাঁর প্রমাণ। আমার মন না চায় এ ঘর বাধি লো কিশোরী প্রাণ না চায় এ ঘর বাধি লো কিশোরী চল না করি ফকিরি।
মামুন নদীয়া উদাস প্রকৃতির মানুষ। তাঁর ঘরসংসারে মন বসে না। তিনি ঘর না বেধে বাউলের জীবন বেছে নিতে চান। ফকিরি করতে চান। আর লালন বলেইছেন : “ছাড়ো ফিকিরি (ধান্ধাবাজি), কর ফকিরি।” আর সেই কথাই এই গানের প্রথমেই মামুন নদীয়া পরিস্কার করেছেন। ফকিরি আর ঘরসংসার যে পরস্পরবিরোধী বস্তু- সেটি আমরা সবাই তিক্ত অভিজ্ঞতায় বুঝেছি। সংসারের সর্বত্র ক্ষুদ্র স্বার্থেরই জয়গান। পক্ষান্তরে ফকিরি পবিত্র এক মার্গ।
মামুন নদীয়া বাউলের জীবন বেছে নিতে চান। বেশ কথা। কিন্তু কথাটা তিনি একজন কিশোরীকে বলছেন কেন? কারণ, তিনি পথের সঙ্গীনি হিসেবে একজন কিশোরীর সাহচার্য চান। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের অস্টম/নবম শতকের তান্ত্রিক বৌদ্ধদের একটি চর্যার পদ স্মরণ করতে হবে। চর্যার সেই পদটি হল:- তো বিনু তরুণি নিরন্তর ণেহে/ বোধি কি লভ ভই প্রণ বি দেঁহে। অর্থাৎ, তর“ণির নিরন্তর স্নেহ বিনা বোধি বা ঊহষরমযঃবহসবহঃ লাভ করা সম্ভব না। মামুন নদীয়া বোধিলাভ বা পরমজ্ঞান লাভ করতে চান। কাজেই তিনি বাংলার পথেপ্রান্তরে সাধনসঙ্গীনি হিসেবে একজন কিশোরীর সান্নিধ্য কামনা করেন ।
তিনি তার জীবদ্দশায় বেশ কিছু গানের এলবাম রেখে গেছেন। তার বিভন্ন কর্মের মাঝে তিনি ভক্তদের মাঝে তাদের স্মৃতিতে জাগ্রত হয়ে আছেন। সকলেরই যেতে হবে ওই পরপাড়ে। তবে কৃতকর্মের মাধ্যমে মুক্তির সেই কর্মগুলোকে চিনে সেপথেই সকলকে এগুনো দরকার। এমনটিই ভাবনা শাস্ত্রবিদদের। ওপারে ভালো থাকুক মামুন নদীয়া।