দৃষ্টিশক্তিহীন ছেলের পড়া রেকর্ড হয় মায়ের স্বরে। মুঠোফোনের ওই রেকর্ড মন দিয়ে শোনেন ছেলে। এটাই তার পড়ার একমাত্র উপায়। মা-ছেলের অনবদ্য এই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়। এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান আবদুল্লাহ আল শাইম। আর সাধারণ এক নারী চায়না খাতুন হয়ে ওঠেন অদম্য মা। মায়ের তৈরি করা পড়ার রেকর্ড শুনেই কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার পিপলস ডিগ্রি কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ। তিনি পরীক্ষা দিয়েছিলেন শ্রুতি লেখকের সহায়তায়।
আবদুল্লাহ জন্মান্ধ ছিলেন না। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম তিনি বুঝতে পারেন তার দুই চোখেই সমস্যা হচ্ছে। কোনো কিছুই ভালো করে দেখতে পেতেন না। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ভাত-বস্ত্রের সংস্থানই ঠিকমতো হয় না তাদের। কিন্তু চোখের সমস্যা দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আবদুল্লাহ চিকিৎসকের কাছে গিয়েছেন ঠিকই, তত দিনে তার দুচোখ প্রায় দৃষ্টিশূন্য হয়ে গেছে। একসময় অনেক কষ্টে চক্ষুচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ওই যাওয়া পর্যন্তই! অর্থকষ্টের কারণে তার যথাযথ চিকিৎসা আর হয়ে ওঠেনি। চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, আবদুল্লাহর দুচোখ ‘রেটিনাইটস পিগসোনটোসা’ রোগে আক্রান্ত।
প্রায়ান্ধ অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষা দিতে হয় আবদুল্লাহকে। পরীক্ষার হলে টেবিলের দুপাশে দুটি টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে কোনো রকমে পরীক্ষা শেষ করেন তিনি। প্রশ্নই ঠিকমতো পড়তে পারতেন না তিনি। মন ভেঙে দেওয়া সেই পরীক্ষার কথা আজও ভুলতে পারেননি আবদুল্লাহ। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৪ পেয়ে পাস করেন।
ফল ঘোষণার পর আবদুল্লাহর পরিবার শেষ চেষ্টা হিসেবে কুষ্টিয়া থেকে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। আরও দু-তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করেন তারা। শেষমেশ আবদুল্লাহকে নেওয়া হয় ফার্মগেট এলাকার ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ও ইস্পাহানি ইনস্টিটিউট অব থালমোলোজিতে। তত দিনে তিনি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছেন।
ঢাকা থেকে ফেরার পর আবদুল্লাহর পরিবার কুষ্টিয়া শহরের একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে যোগাযোগ করে।
সেখানে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া হয়। তবে সেখান থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে হলে তাকে শহরে থাকতে হতো। সেই খরচ তার পরিবারের পক্ষে মেটানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি আবদুল্লাহর আগ্রহ দেখে ওই স্কুলের কর্মকর্তা এনামুল হক (বর্তমানে প্রয়াত) তাকে ক্যাসেটে পড়া রেকর্ড করে তা শোনার পরামর্শ দেন। এই পদ্ধতি তার ভালো লাগলে শ্রুতি লেখক দিয়ে তিনি এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারবেন বলে তিনি জানান। পরে বাড়িতে ফিরে তার মায়ের পরামর্শে মুঠোফোনেই পড়া রেকর্ড করে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আবদুল্লাহ।