কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য ১০০ বিছানা তৈরি করা হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে এ রোগের সেবা দেওয়ার জন্য নার্স ও ডাক্তার, কিন্তু সেখানে কোন রোগী নেই। রোগিরা নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন, কেউ বাজার-ঘাটে যাচ্ছেন, চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন আবার কেউ বিয়ের পিঁড়িতে বসে জরিমানাও গুনেছেন।
করোনাভাইরাসকে অবজ্ঞা করে সব থেকে আলোচিত ঘটনা ঘটেছে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলায়। গতকাল ভেড়ামারা পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের বামনপাড়ার একজন ঢাকাতে থাকাবস্থায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। অথচ ভয়ঙ্কর এই তথ্য গোপন করে সে গত ৩১ মে ঢাকা থেকে বামনপাড়াস্থ নিজ বাসায় চলে আসে। বাড়িতে আসার পর মাহবুব বাজারসহ অন্যান্য বিভিন্নস্থানে বেপরোয়াভাবে যাতায়াত করেছে।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে পৌর মেয়র আলহাজ্জ্ব শামীমুল ইসলাম ছানা এবং ৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মেহেদী হাসান সবুজ তৎক্ষণিক ইমাম বক্স’র বাড়িতে গিয়ে ঐ বাড়িটি লকডাউন করে বাড়ির সামনে লাল ফ্ল্যাগ টাঙিয়ে দেন।
এর আগে গত ২৩ মে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার করোনা আক্রান্ত এক যুবক ঢাকা থেকে এসে ২৪ মে বিয়ে করেন। অন্যদিকে কুষ্টিয়া সদরে গত ২৮ মে কুষ্টিয়ায় ৮ রোগী শনাক্ত হয়, তার মধ্যে সদর উপজেলার হরিনারায়নপুর ইউনিয়নের বাড়াদী গ্রামে রয়েছে ৩জন। আমেরিকা ফেরত ঐ রোগীরা এলাকাতে প্রভাবশালী হওয়ায় তারা সকল স্বাভাবিক কাজকর্মের সঙ্গে নানা উৎসবেও যোগ দিচ্ছেন।
কুষ্টিয়া সদরের হাটশ হরিপুরের একজন কুষ্টিয়া মিউনিসিপাল বাজারের মাছের আড়ৎ কর্মরত ছিলেন। ৩১ মে ফলাফল নেগেটিভ আসলেও তিনি কাজ-কর্ম চালিয়ে গেছেন।গত সোমবার ১ জুন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম. সম্পা মাহামুদ গ্রাম পুলিশের সহযোগিতায় বাড়িটি লক ডাউন ঘোষণা করে।
গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত কুষ্টিয়া পলিমারী চেইন রিএ্যাকশন (পিসিআর) ল্যাব থেকে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার শতাধিক রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ তিন জেলার রোগীদের করোনা চিকিৎসারর একমাত্র বিশেষায়িত কেন্দ্র কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল।
এখানে করোনা চিকিৎসার জন্য জনবলসহ ১০০ বেডের আইসোলেশন ইউনিট করা হয়েছে। এ হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. তাপস কুমার সরকার বলেন, বেশ কয়েকদিন হলো, হাসপাতালে কোন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী নেই।
তিনি বলেন, এখানে মোট ৬জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, তারা সুস্থ্য হয়ে স্বাভাবিক কাজকর্মের ফিরে গেছেন।যেসব রোগীর উপসর্গ বেশি, যাদের নিয়ে ঝুঁকি আছে তাদেরকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু যাদের লক্ষণ তেমন না, শরীরে বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া নেই তারা বাড়িতেই আইসোলশনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
কুষ্টিয়ায় ঈদের আগে দোকান খুলে দেওয়ায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মানুষ ভিড় জমায় মার্কেটে। তাদের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কুষ্টিয়া জেলাপ্রশাসকের ফেসবুক পেজ থেকে জানা গেছে, ঈদের পরে ২৭ মে কুষ্টিয়ায় ২০ জনের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়, সেদিন পর্যন্ত কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় মোট আক্রান্ত ছিল ৩৯জন। এর পর তা বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। গত ২৮ তারিখে ১৩৮ জনের মধ্যে এ তিন জেলা থেকে ১০জন, ২৯ তারিখে ১৩৬ জনের মধ্যে ১৮ জন, ৩০ মে ৫০ জনের স্যাম্পল পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে ৮ জন, ৩১ মে ২১০ জনের মধ্যে ১৪ জন, ১ জুন ১৩৮ জনের মধ্যে ১ জন এবং গতকাল ২ জুন ১৮৭ টি স্যাম্পল পরীক্ষা করে ১১ জন করোনারোগী শনাক্ত করা হয়। সব মিলে গতকাল পর্যন্ত এ তিন জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১০১জন।
কুষ্টিয়া জেলায় প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় গত ২ এপ্রিল। কুষ্টিয়া শহরের আড়ুয়াপাড়ার ব্যাংকার মাহবুব আহমেদ চপ্পল (৩০) করোনারোগী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর পরই প্রশাসন শক্ত অবস্থানে যায়। তখন থেকে ঈদ পর্যন্ত অবস্থা স্বাভাবিক ছিল। সহজেই বোঝা যায়, গত ছয় দিনে এই তিন জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬২জনে।
কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত বলেন, রোগী শনাক্তের পর পরই তার বাড়ি লডডাউন করা হয়েছে, প্রয়োজনে সেখানে পুলিশী নজদরদারী ও প্রহরা বসানো হবে। এলাকার মানুষকেও সতর্ক করা হচ্ছে এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাকে বাড়ি থেকে বের না হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। সব দিকেই কড়া নজর রাখা হয়েছে। তিনি করোনা রোগীদের ফ্রি-স্টাইলে ঘুরে বেড়ানোর কোন অভিযোগ পাননি, পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান।
জেলাপ্রশাসক মো. আসলাম হোসেন বলেন, জেলাকে করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে সব রকমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন। দিন-রাত কাজ ও মনিটরিং চলছে, তিনি সবার আগে প্রত্যেককে সচিতন হওয়ার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক এ করোনাভাইরাসকে মোকাবেলা করতে হলে সবার আগে আমাদের স্বস্থ্যবিধি মানতে হবে। কুষ্টিয়ার করোনারোগীরা বাইরে ঘোরাঘুরি করছে এমন তথ্য তার কাছে নেই বলে তিনি জানান। ঘরের বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন। অতি-প্রয়োজনীয় না হলে বাহিরে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। সামাজিক দুরত্ব মেনে চলুন। অনুগ্রহ করে সতর্ক থাকুন, সাবধানে থাকুন।