আবারও সেই নিউমার্কেট এলাকা।
আবারও দোকানির রক্ত চক্ষু, একা পেয়ে হামলে পড়া। আবারও নারী হয়রানি। কিন্তু আবারও সেই পরাজয়ের গল্প এটি নয়। ভূক্তভোগি নারীর চোখের জলেও শেষ হয়নি এ গল্প। দিন শেষে তৈরি হয়েছে দারুণ এক প্রতিবাদের উদাহরণ।
গত কয়েক বছর ধরে মার্কেটকেন্দ্রীক হয়রানি বন্ধে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের ক্যাম্পেইন করছি। লিখছি কিভাবে, কোথায়, কার কাছে অভিযোগটি জানাতে হবে। কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই একই কাণ্ড। বিপদে পড়লে পুরুষ সমাজকে গালি দিয়ে একখানা ফেসবুক স্টাটাস। বহু মানুষের সেখানে আমাকে ট্যাগ করেন। দিন শেষে আমাকেই সংশ্লিষ্ট যায়গাগুলোতে বলে দিতে হয়েছে কিংবা নিজে গিয়ে সাহায্য করতে হয়েছে। দিনে দিনে উদাহরণে পরিণত করা প্রতিবাদের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিটি কেউ রেপ্লিকেট করেনি। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম এক ঘটনা ঘটেছে।
বিকেলে নিউমার্কেট জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার সাজ্জাদ রায়হান ফোন দিলেন। বললেন, ‘তোমাকে ধন্যবাদ ইমরান।’ বোকার মতো জানতে চাইলাম, ‘আবার কি করলাম?’
বললেন, ‘তোমার নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ তো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে। একটু আগেও দুই মেয়ে মার্কেট এলাকা থেকে ফোন দিয়েছিল। তোমার পোস্ট পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে হয়রানির প্রতিবাদ করেছে। আমরাও ফোর্স পাঠিয়ে উত্যক্তকারী দোকানিকে ধরে এনেছি। এখনও থানায় আছে। ফ্রি থাকলে আসো।’
অনুসন্ধানের কাজে পাশেই আলিয়া মাদ্রাসায় ছিলাম।
গাড়ি ঘুরিয়ে থানায় গিয়ে দেখি কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে। সন্নিকটে রাজ্য জয়ের আনন্দ নিয়ে বসে আছে দুই মেয়ে। পেশায় একজন ফার্মাসিস্ট, অন্যতম উত্তরার একটি বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সম্পর্কে দুজন খালাতো বোন।
এদের কেউই আমাকে চেনে না, তবে আমার এ সংক্রান্ত কয়েকটি পোস্ট তাদের ফোনে সেভ করা আছে। সেখান থেকে নাম্বার নিয়ে ফোন করেছিল সাজ্জাদ ভাইকে। আনন্দে আমার মন ভরে গেল, বুক ভরে গেল। তার মানে, ইট ওয়ার্কস!
ঘটনার সারমর্ম হলো, নিজের বিয়ের কেনাকাটা করতে নিউ মার্কেট এলাকায় এসেছিলেন এই দুই নারী। গাউসিয়ার নূর ম্যানশনের নিচতলায় খাবারের দোকান ক্যাফে স্নাকসের সম্মুখে একটি ফুটপাত থেকে চুলের ক্লিপ কিনতে চেয়েছিলেন তারা। দরদাম নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ে দোকানি রাসেল খান। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, একে তো নারী ক্রেতা তার উপর প্রতিবাদ করায় তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে রাসেল। অকথ্য ভাষায় গালাগাল তো আছেই, মারতেও উদ্যত হয়।
ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয় এমন গালি শুনে হতভম্ব দুই নারী কি করবে বুঝে পায় না! এমন সময় আমার পোস্টের কথা মনে পড়ে একজনের। মনে পড়ে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের প্রক্রিয়াও। সেই মতে সাজ্জাদ ভাইকে ফোন। এবং ত্বড়িৎ এ্যাকশন।
মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে ধরে আনা হয়েছে। এবার আইনী পদক্ষেপের পালা। ওসি (তদন্ত) শের আলম ভাই মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে আছেন।
কিন্তু মেয়েরা মামলা করতে চায় না। তারা এটিকে উটকো ঝামেলা মনে করছে! মামলা ছাড়া তো এই অপরাধীর উপযুক্ত সাজা সম্ভব নয়। অনেক বুঝিয়েও রাজি করানো গেল না।
কি আর করা! কানে ধরিয়ে, পা ধরে মাফ চাইয়ে এ যাত্রায় ছেড়ে দেওয়া হলো খান সাহেবকে। ভয়ের চোটে কয়েক দফা মেয়েদের মা বলেও ডাকল রাসেল। অথচ কয়েক ঘণ্টা আগেই যারা ছিল পথের মেয়ে মানুষ!
এই এলাকার মার্কেটগুলোতে হাজার হাজার নারী নিত্য কেনাকাটা করতে যান। দোকানের বদমায়েশ কিছু কর্মচারীর দ্বারা প্রতিনিয়তই এসব নারীরা নানা ভাবে নিগৃহীত হন, হয়রানির শিকার হন। মুখ বুজে সহ্য করায় দিনে দিনে ব্যাপারটিকে তারা নিয়মে পরিণত করে ফেলেছেন।
এসব ঘটনায় দু-একজন যদিও বা প্রতিবাদ করে, সদলবলে ওরা তখোন হামলে পড়ে। প্রায়শই সেইসব দুঃখের কাহিনী ফেসবুকে শেয়ার করেন ভূক্তভোগি নারীরা। কিন্তু প্রতিবাদের সঠিক রাস্তাটা জানা না থাকায় অনেকেই ইচ্ছা থাকা সত্যেও প্রতিকার পাননা। প্রতিবাদী নারীদের জন্য আজকের ঘটনাটা আলোকজ্জ্বল একটা উদাহরণ হতে পারে।
একটু সাহস নিয়ে এগিয়ে এলে, নিয়ম মেনে প্রতিবাদ করলে এবং সেই প্রতিবাদটা সঠিক যায়গায় পৌঁছে দিতে পারলে- এই দেশেও যে অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া সম্ভব, এসব ঘটনায় তা কিন্তু বারবার প্রমাণিত হচ্ছে।
নেই নেই করেও আমাদের দেশে যতটুকু নাগরিক সুযোগ-সুবিধা আছে, আইন আছে আমরা তার কতটুকু ব্যবহার করতে পারছি?
সহকারী কমিশনার সাজ্জাদ রায়হান ভাইকে ধন্যবাদ দিলে কম হবে। শুধু এটুকু বলব, আপনাদের মতো অফিসার আছে বলেই এখনও সব নষ্টদের অধিকারে যায়নি। আপনারা পথে চলাচলকারী নারীদের জন্য ফেরেশতা। স্যালুট আপনাকে।
মার্কেট এলাকায় প্রতিনিয়ত অনিয়ম-দূর্ভোগের শিকার নারীদের মধ্যে যারা ফেসবুকে চিল্লাপাল্লা না করে সত্যি সত্যিই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চান, তারা আমাদের এই নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের পথটা অনুসরণ করতে পারেন। অবশ্যই প্রতিকার পাবেন। কেননা আমরা প্রতিনিয়ত নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের উদাহরণ তৈরি করে যাচ্ছি।
আর হ্যা, মনে রাখবেন, আপনার প্রতিবাদটি অন্য কেউ এসে করে দিয়ে যাবে না। শুরুটা অন্তত আপনাকেই করতে হবে। এই দেশে কিছু হয় না বলে যারা পাশ কাটিয়ে যান, যারা প্রতিবাদের বদলে প্রতিনিয়ত অন্যায়কে মেনে নেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, নিজের যায়গা থেকে একটুখানি আওয়াজ তুলুন। জনারণ্যে শুরুতে সেই আওয়াজ বড় ক্ষীণ আর বেমানান ঠেকলেও ধীরে ধীরে দেখবেন আরো সহস্র আওয়াজ আপনার দিকে ছুটে আসছে। গণমানুষের সম্মিলিত সেই আওয়াজের সামনে দাঁড়ায়, এমন অপশক্তি কোথায়?
https://www.facebook.com/abdullah.al.imran07/videos/10216843980441403/
সূত্র – Abdullah Al Imran (from FACEBOOK)