‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ শব্দবন্ধটি নিঃসন্দেহে এ মুহূর্তে দেশের সর্বত্রই আলোচনার ভরকেন্দ্র। অস্বীকার করার উপায় নেই, গ্রিক মনীষীদের অমেয় বৌদ্ধিক সাহচর্য মানবসভ্যতার বিকাশে, জীবন ব্যবস্থায় ইতিবাচক বদল আনতে নির্ণায়ক অনুঘটকের কাজ করেছে। গণতন্ত্রের ধারণাও সেই গ্রিক পণ্ডিতদের ঋদ্ধ ভাবনার ফলিত উত্তরাধিকার। প্রচলিত অর্থে গণতন্ত্র হল- সরকার পরিচালনায় সব নাগরিকের সুষম অংশীদারিত্ব, প্রবলভাবে চর্চিত, জনপ্রিয় রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি।
উল্লেখ করা বাতুলতার নামান্তর যে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে কিনা অথবা, আরও স্পষ্ট করে বললে, নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশ নেয়া বা না নেয়ার প্রসঙ্গই বর্তমান সময়ে চলমান আলোচনার মুখ্য বিষয়বস্তু। সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নির্বাচনকে শুধু অর্থবহ করে না, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়, তাতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয়। গণতন্ত্রে ভিন্নমত, বহুমত ও বিপ্রতীপ আদর্শের সংস্থান চিরন্তন, যুগসিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন বিষয়ে বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা নতুন নয়।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের প্রসঙ্গে আসি। আমাদের প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি পঞ্চায়েত নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, দুই বাংলায় একই সময় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করছে, তা কি নিছক কাকতালীয় না বাঙালির নেতিবাচক উত্তরাধিকারের প্রলম্বিত বিস্তার। তাত্ত্বিক দিক থেকে মিল থাকলেও, প্রক্রিয়াগত অমিলও দৃশ্যমান। ভারতের গণতন্ত্র বৃহত্তর, প্রবৃদ্ধ। তাই পশ্চিমবঙ্গের বিচ্যুতির দায় বাংলাদেশ থেকে গভীরতর, প্রবলতর। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত রাজ্যের নির্বাচনী ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে অনীহা প্রকাশ করলেও কলকাতা হাইকোর্ট দফায় দফায় নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু সহিংসতা কমেনি, কার্যত বিরোধীরাও কোনো সুরাহা পায়নি। মার্কসীয় আদর্শে ঋদ্ধ কমিউনিস্ট বা তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে শাসকের চরিত্র বিচারে কোনো আদর্শগত ফারাক দেখা যায়নি। বিচ্যুতি কখনও দৃষ্টান্ত হতে পারে না, অন্যায় পৃথিবীর যেখানেই ঘটুক তা ন্যায়কে বিপন্ন করে। ইতিহাসের এই অমোঘ শিক্ষার মর্মার্থকে ধারণ করে ‘অংশগ্রহণ’ শব্দের বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের পথরেখায় আজকের আলোচনাকে নিবদ্ধ রাখতে চাই।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ নির্বাচন, যার মাধ্যমে দেশের সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক নির্দিষ্ট মেয়াদে সরকার পরিচালনার জন্য যোগ্য জনপ্রতিনিধি বাছাই করেন। দেশের সংবিধান সব নাগরিকের প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছে। শ্রেণী-বর্গ, জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ, দল-মত নির্বিশেষে সবার ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ সাংবিধানিকভাবে উন্মুক্ত। তবে এ কথা বলতেই হবে যে, এ দেশে ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত অধিকাংশ নির্বাচনে সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের নির্বিঘ্ন সুযোগ সৃষ্টি করতে রাষ্ট্রযন্ত্র কতটা সফল হয়েছে বা ভোট প্রক্রিয়ায় সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের বিষয়টি জনমনে গুরুত্বের সঙ্গে জায়গা করে নিতে পেরেছে কিনা তা নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণসাপেক্ষ।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে সর্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত ছিল না। কর প্রদান বা শিক্ষার একটি নির্দিষ্ট যোগ্যতা ভোটার হওয়ার মানদণ্ড ছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও জনগণের এই মৌলিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না। গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ অধিকার অর্জন করা সম্ভব হলেও তা কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এমনকি বাংলাদেশ সৃষ্টির অন্যতম কারণও ছিল বল প্রয়োগে গণরায়কে উপেক্ষা করার মূঢ় ঔদ্ধত্য। একটি সর্বাত্মক জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের সদর্প আত্মপ্রকাশ ঘটে বিশ্বমানচিত্রে; যার আদর্শিক ভিত্তি ছিল সাম্য, সামাজিক ন্যায় ও মানবিক মর্যাদা।
পরিতাপের বিষয় হল, দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরই জাতীয় চার নেতাসহ জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ড, হত্যাকারীদের দায়মুক্তি ও দীর্ঘ সামরিক শাসন সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রমশ দুর্বল করে ফেলে। বস্তুত পঁচাত্তর-পরবর্তী পর্বে দেশ একটি দিশাহীন, জটিল আর্থ-সামাজিক ক্রান্তিকালে প্রবেশ করে। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, কর্তৃত্ববাদী শাসন ও সুশাসনের ঘাটতি সমাজ দেহে অমোচনীয় ক্ষতের সৃষ্টি করে এবং আজকের এই দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক অচলায়তন অনেকাংশেই এই ন্যায়ভ্রষ্ট সময়ের অনিবার্য অভিঘাত। শিক্ষাঙ্গনে নকল ও সন্ত্রাস, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি সংস্কৃতির উদ্ভব, অধিকাংশ সেবা খাতে লাগামহীন দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, অনিয়ন্ত্রিত বাজারে সুবিধাভোগী বণিক শ্রেণীর দাপট- কার্যত একটি নব্য ধনিক শ্রেণীর অনায়াস বিকাশকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে, যা শুধু সমাজবুননের আদলকে বদলে দেয়নি, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ গঠনের প্রক্রিয়াগত কাঠামোকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। অন্যদিকে ক্ষমতা ও বিত্তের প্রশ্রয়ে মতাদর্শিক দোলাচলকে পুঁজি করে মৌলবাদের বিস্তার পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশকের নৈতিক, মানবিক, প্রগতিশীল ও পরিশীলিত জাতীয়তাবাদী চেতনার পরিসরকে ক্রমাগত সংকুচিত করতে শুরু করে। এমনই এক ধোঁয়াশার মাঝে বিত্ত, পেশি ও সাম্প্রদায়িকতার নির্বিচার প্রয়োগের ফলে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
নির্বাচন এলেই যে বিষয়টি সামনে এসে পড়ে তা হল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা। বাংলাদেশের কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি এদের দুর্বলতা বেশি থাকায় তারা নিজেরাই ঝুঁকিপূর্ণ বলয়ে চলে যায়। বিশ্লেষণের ভঙ্গি ও প্রক্রিয়ার মাঝেই পক্ষপাতদুষ্ট সরলীকরণের আভাস মেলে অর্থাৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত নাগরিককে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হবে তার পছন্দের ভিত্তিতে নয়, আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে বিবেককে বিভাজিত করতে হবে- এ কেমন যুক্তি? এ এক অভিনব বিচারবোধ। জানা উচিত, নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আতঙ্ক ও ভিটেছাড়া হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা জনমিতিতে তাদের অস্তিত্বকে তলানিতে নামিয়ে এনেছে। ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী এবং ২০১৩ থেকে ২০১৫ অবধি নির্বাচন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছে- তার দৃষ্টান্তমূলক কোনো বিচার এখনও হয়নি- দায়মুক্তির এই সংস্কৃতি সমাজের দুর্বলতর শ্রেণীকে আরও প্রান্তিক করে তুলেছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, নির্বাচনে বিজয়ী ও বিজিত উভয় দলই অনেক ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়া বা না হওয়াকে দায়ী করে থাকে। অর্পিত সম্পত্তি অধ্যাদেশের অভিশাপে বিপর্যস্ত এ সম্প্রদায় নির্বাচন এলেই অজানিত আশঙ্কায় কাতর হয়ে ওঠে এবং নীবর দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে তাৎক্ষণিক স্বস্তির পরিসর খুঁজে নেয়, কিন্তু বাস্তুহারা হওয়ার সুদূরপ্রসারী মনোজাগতিক অভিঘাত প্রলম্বিত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। সঙ্গত কারণেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের তত্ত্ব জনসংখ্যার এ অংশের ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। আর নির্বাচন শব্দের সঙ্গে যুক্ত অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, উৎসবমুখর ইত্যাদি বিশেষণ শ্লেষাত্মক মনে হয়।
আমাদের এ জনপদে নির্বাচনী পরিবেশে উৎসবের মেজাজ খুঁজে নেয়ার একটা নির্দোষ প্রয়াস লক্ষণীয়। নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি ঘনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ; যেখানে আবেগের জায়গা নেই, আছে নিয়মের শাসন। নাগরিকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়া। উৎসবে আবেগ আছে, চাপ নেই। ভোটকেন্দ্র যদি মিলনের তীর্থ হয়ে যায়, ভয়-শঙ্কামুক্ত, নির্ভার মানবমনের সঙ্গমে পরিণত হয়, তাহলেই নির্বাচন হয়ে উঠতে পারে ভোটের উৎসব। ভোট কেন্দ্র যদি হিংসা, হানাহানি ও সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়, উৎসবের উপাদান তখন নিমিষেই অন্তর্হিত হয়।
বিত্ত ও পেশির সহযোগে নির্বাচনী পরিবেশকে শক্তির অনুকূলে প্রভাবিত করার সুযোগ বর্তমান বাস্তবতায় যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান আছে। শিক্ষা, দীক্ষা, আর্থিক সামর্থ্য বা সামাজিক মর্যাদায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এখনও ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ আদর্শ, কর্মসূচি বা নির্বাচনী ইশতেহার বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেন না। এ সবক্ষেত্রে অর্থ, পেশি বা ধর্মীয় আবেগকে অত্যন্ত কৌশলে ব্যবহার করে জনসাধারণকে প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে। সামাজিকভাবে দুর্বলতর শ্রেণীভুক্ত মানুষকে ভয়-ভীতি প্রদান করে বা বৈষয়িক প্রলোভনে ভোট কেন্দ্রে নেয়া যায় বা নির্বাচনের পর সহিংতার আশঙ্কায়ও অনেক ভোটারকে ভোট দানে নিরুসাহিত করা যায়। বাংলাদেশে এমন এলাকা অনেক আছে, যেখানে যুগের পর যুগ পুরুষতন্ত্রের কাছে নারীর অসহায় আত্মসমর্পণের ফলে নারী ভোটাররা এখনও ভোট কেন্দ্রে ব্রাত্য। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়েও ভোটের হাওয়া নাটকীয়ভাবে নিজের অনুকূলে নেয়ার নজিরও বিরল নয়। এমন সহজলভ্য উপায় থাকার কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি দেখা যায় না।
সমাজের দুর্বলতর শ্রেণীর মানুষকে শুধু অর্থ বা পেশির মাধ্যমে নয়, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগের মাধ্যমেও প্রভাবিত করার অপপ্রয়াস বিদ্যমান নির্বাচনী সংস্কৃতির অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এই অনভিপ্রেত সামাজিক দূষণ সুষ্ঠু নির্বাচনী বাতাবরণ নির্মাণের পথে স্পষ্ট অন্তরায়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের পক্ষ থেকে নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ প্রয়োজন। ব্যক্তিগত বা দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে বিজয়ী সবকিছু অধিকার করলে এবং পরাজিতের জন্য কিছু অবশিষ্ট না থাকার নজির সৃষ্টি হলে অথবা একের অস্তিত্ব যদি অন্যের বিনাশের কারণ হয়, তবে পারস্পরিক অবিশ্বাস সংঘাতের পরিবেশকে ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর করে তুলবে। একটি দল কেন ক্ষমতায় যাবে বা অন্য দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিই বা কী অথবা অতীতে প্রণীত কর্মসূচির বাস্তবায়ন কোন্ দল কতটুকু করেছে তার তুলনামূলক সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান তুলে ধরে জনমত নিজের অনুকূলে আনার প্রচেষ্টার পরিবর্তে নেতিবাচক সমর্থন বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়াকে নিজের গায়ে লাগিয়ে নেয়ার সুবিধাবাদী অপপ্রয়াস নির্বাচনকে সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে নিয়ে যায়। বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন সামরিক বাহিনী মোতায়েনের দাবি জোরালো হচ্ছে; কিন্তু এ দাবির মধ্যেও স্পষ্ট স্ববিরোধিতা নিহিত। কারণ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচনও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেনি। মোদ্দাকথা, পরাজিত হলে কোনো দলই সেটা মেনে নেয়নি। জয়-পরাজয় স্বাভাবিক নিয়মে মেনে নেয়ার চর্চা অবিলম্বে শুরু না হলে সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হবে। সত্যকে মেনে নেয়ার সংস্কৃতি লালন করা বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বার্থে অত্যন্ত জরুরি।
সার্বিক নির্বাচনী পরিবেশকে জনবান্ধব করার বিষয়টি কেবল সরকার বা নির্বাচন কমিশনের উপর বর্তায় না। সমাজদেহে যদি কোনো ক্ষত সৃষ্টি হয়ে থাকে, তার উপশম তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপত্রে নিহিত থাকে না। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি নিরবচ্ছিন্ন ও পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। সমন্বিত উদ্যোগ। দীর্ঘ সংগ্রাম ও নিরন্তর চর্চার মধ্য দিয়ে আমরা জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের নানা পর্যায়ে যে উচ্চ আদর্শিক ও নৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলাম, তার পুনর্নির্মাণ জরুরি। সরকারি-বিরোধী নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দল, সংস্থা, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমকর্মী, সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে একযোগে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ করে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে বিশ্বাসযোগ্য ও টেকসই করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সততা ও সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করতে হবে। শুধু দ্বিদলীয় মেরুকরণ নয়, দেশের সব নাগরিক যাতে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী-লিঙ্গ নির্বিশেষে ভোট কেন্দ্রে নির্বিঘ্ন উপস্থিত হতে পারে তা নিশ্চিত করতে পারলেই বলা যাবে নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ ঘটেছে। সমকালীন ভূরাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বহির্বিশ্বে আমাদের মর্যাদা, অভীষ্ট অর্জনে আমাদের করণীয়, তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের কৌশল নিরূপণ ও প্রস্তুতির কথা মাথায় রেখে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে বহুত্ববাদী, জবাবদিহিমূলক, ক্ষুধামুক্ত, সহিষ্ণু বাংলাদেশ নির্মাণ করার সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বাঙালি জাতি মেধায়, মননে, সংবেদনশীলতায় ঐশ্বর্যমণ্ডিত, রাজনীতি বাঙালির নিঃশ্বাসে, প্রশ্বাসে, শিরায় শিরায় প্রবাহিত। তাই ভরসা রাখা যায়, নাগরিক মানসে বিরাজিত নীতিঘনিষ্ঠ শুভ সত্তার অবিনশ্বর উপস্থিতি ভ্রান্তির আঁধারকে দীর্ঘায়িত করবে না। পারস্পরিক সংশয় ও অনাস্থার মেঘ অপসৃত হবে। সম্প্রীতি, সহিষ্ণুতা ও সুস্থতার স্নিগ্ধ বাতাসে ভরে উঠবে বাংলার এ মুক্ত আকাশ।
অমিত রায় চৌধুরী : শিক্ষাবিদ
principalffmmc@gmail.com