কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন অফিসের হিসাবরক্ষক আবদুল কুদ্দুস। চাকরি জীবনের শুরুটা মালি হিসেবে। ১৯৮০ সালে কুষ্টিয়া শহরের নিশান মোড়ের সিভিল সার্জন পরিচালিত ম্যালেরিয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রথম যোগদান। ডিউটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বাগান ও গাছ পরিচর্যা।
কয়েক বছরের মধ্যেই অফিস সহকারী হিসেবে পদোন্নতি। যোগদান করেন কুষ্টিয়া নার্সিং ইন্সটিটিউটে। ১৯৯০ সালের দিকে আরেক দফা পদোন্নতি পেয়ে কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন অফিসের হিসাবরক্ষক হন আবদুল কুদ্দুস। এর পরের গল্পটা আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্যের গল্পকেও যেন হার মানায়।
মালী থেকে হিসাবরক্ষক আবদুল কুদ্দুস কয়েক বছরের ব্যবধানে বনে গেছেন অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক। কুষ্টিয়া শহরে তার রয়েছে দুটি বহুতল ভবন ও একটি একতলা ভবন। শহরের অভিজাত এলাকায় আছে ফ্ল্যাট। মার্কেটে আছে একাধিক দোকান ও ফ্লোর। ঢাকায় রয়েছে দুটি ফ্ল্যাট। স্ত্রী-সন্তান থাকেন ঢাকার ফ্ল্যাটে। চলাফেরা করেন দামি প্রাইভেট কারে। নিজে থাকেন কুষ্টিয়ার বাড়িতে। এছাড়া একাধিক ব্যাংকে রয়েছে তার কোটি টাকা।
এদিকে সামান্য হিসাবরক্ষক হলেও তিনিই অফিসের সর্বেসর্বা। সিভিল সার্জন অফিসের সব টেন্ডার তার নিয়ন্ত্রণে। ক্ষমতাশীন দলের নেতাদের যোগসাজশে এগুলো একাই নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। অফিসের কেউ ভয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না। আবদুল কুদ্দুসের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে অফিসের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। কিন্তু আবদুল কুদ্দুসের অসীম ক্ষমতার ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুষ্টিয়া শহরের কোর্টপাড়ার স্যার ইকবাল রোডের ২৬/১ নম্বর বাড়িটি দেড় কোটি টাকা দিয়ে কিনেছেন আবদুল কুদ্দুস। কয়েক মাস আগে চার কাঠা জমির ওপর অবস্থিত ‘প্রবাসী কেয়া’ নামে আলিশান বাড়িটি তার স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। চার তলাবিশিষ্ট বাড়িটিতে রয়েছে ৮টি ফ্ল্যাট। এগুলো থেকে প্রতি মাসে ভাড়া পান প্রায় ৫০ হাজার টাকা। কুষ্টিয়া শহরের কোর্টপাড়া এলাকায় পাঁচ কাঠা জমির ওপর আবদুল কুদ্দুস নিজেই নির্মাণ করেছেন পাঁচ তলাবিশিষ্ট আলিশান বাড়ি। ২/২ শহীদ আবদুল হামিদ রোডের শাওলী ভিলা’ নামে বাড়িটি নির্মাণ করেন তিনি। বর্তমানে বাড়ির সব তলাতেই ছাত্রী হোস্টেল। প্রতিটি রুমে তিন থেকে চারটি বেড বসিয়ে কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। শহরের চৌড়হাস এলাকায় আবদুল কুদ্দুস এক তলাবিশিষ্ট আরও একটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন। উপজেলা পরিষদের সামনে ওসিম-কাসিম সড়কের ওই বাড়িটি চার কাঠা জমির ওপর নির্মিত। বাড়িতে রয়েছেন তিনজন ভাড়াটিয়া। বাড়ি দেখভালের জন্য আলমগীর হোসেন নামে স্থানীয় এক যুবক নিয়োজিত আছেন।
শহরের সবচেয়ে অভিজাত মার্কেট হিসেবে পরিচিত পরিমল টাওয়ারের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় ৩টি দোকান ও চার তলার অর্ধেক ফ্লোর কিনেছেন আবদুল কুদ্দুস। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিমল টাওয়ারের এক কর্মকর্তা জানান, ফ্লোর ও দোকানগুলো স্ত্রী ও তার নিজের নামে কেনা হয়েছে। ওই টাওয়ারের ব্যবসায়ীরা জানান, প্রথম তলার একটি দোকান ৫০ লাখ ও দোতলার দোকান ৩০ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে। এছাড়াও শহরের অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জমি রয়েছে তার। কুষ্টিয়ার একাধিক ব্যাংকে রয়েছে তার কোটি টাকা। রাজধানী ঢাকায়ও আবদুল কুদ্দুসের সম্পদ রয়েছে। ঢাকার মিরপুর-১০ ও শ্যামলীতে দুটি ফ্ল্যাট আছে তার। মিরপুরের ফ্ল্যাটে থাকেন স্ত্রী ও সন্তানরা। তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে এনাম মেডিকেল কলেজে পড়ছেন, অপর মেয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। আবদুল কুদ্দুস প্রতি সপ্তাহে দু’দিন পরিবারের সঙ্গে থাকেন। ঢাকায় স্ত্রী ও সন্তানদের চলাচলের জন্য কিনে দিয়েছেন প্রাইভেট কার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার কয়েকজন সহকর্মী জানান, কুষ্টিয়া নার্সিং ইন্সটিটিউট থেকে আবদুল কুদ্দুসের উত্থান। সেখানে যোগদান করেই নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেসময় মেয়েদের ভর্তি পরীক্ষা ও রেজাল্ট সিট তৈরি হতো স্ব স্ব নার্সিং ইন্সটিটিউটে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবছর অবৈধভাবে মেয়েদের ভর্তি করে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। তখন থেকেই বাড়তে থাকে কুদ্দুসের সম্পদের পরিমাণ। ১৯৯০ সালের দিকে কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন অফিসের হিসাবরক্ষক হিসেবে যোগদান করে পাল্টে যায় কুদ্দুসের জীবনের গল্প।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ঠিকাদার জানান, আবদুল কুদ্দুসের পদবী হিসাবরক্ষক হলেও দীর্ঘ দিন ধরে কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন অফিস তিনিই নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। যে সিভিল সার্জনই কুষ্টিয়ায় আসেন তাকেই নিজের মুরিদ বানিয়ে নেন আবদুল কুদ্দুস। সিভিল সার্জন অফিসে তার কথাই শেষ কথা।
ঠিকাদারদের অভিযোগ, দরপত্র আহ্বানের জন্য পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে এ সংক্রান্ত সব প্রক্রিয়া একাই দেখভাল করেন আবদুল কুদ্দুস। যুগযুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন অফিস। অথচও ভয়ে কেউ তার এসব দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করার সাহস পাননি। ১৯৯৮ সালে সিভিল সার্জন হিসেবে যোগদান করেন মো. বদর উদ্দিন। কথামতো না চলায় তাকে চরম হেনস্থা করে ছাড়েন আবদুল কুদ্দুস। খুলনা ডিডি অফিস থেকে শুরু করে ঢাকা স্বাস্থ্য অধিদফতরেও তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তিনি এতটাই প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর যে, তাকে কেউ চাকরি জীবনের শুরু থেকে কুষ্টিয়া থেকে সরাতে পারেননি। কয়েকবার বদলি হলেও অর্ডার পরিবর্তন করে কয়েক দিনের মধ্যেই আবার কুষ্টিয়া ফিরে এসেছেন।
এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন অফিসের হিসাবরক্ষক আবদুল কুদ্দুস মোবাইলে বলেন, মানুষ কত রকম কথা বলে। সব কিছুই বানানো কথা। আমার কিছু বলার নেই। এত সম্পদ কিভাবে হলো জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, মানুষ শত্র“তা করে এসব কথা বলছে বলেই তিনি ফোন কেটে দেন।
এদিকে কুষ্টিয়া শহরসহ জেলার বিভিন্ন ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গুলোর লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হলেও তাদের বহাল তবিয়তে সেগুলো চালু রাখা ও লাইসেন্স না পেয়েও বেশ কয়েকটি ডায়াগনষ্টিক সেন্টার থেকে নিয়মিত মাসোহারা অভিযোগ রয়েছে সিভিল সার্জনের এই কর্মচারীর বিরুদ্ধে। কুষ্টিয়া শহরসহ জেলার বেশকিছু ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের লাইসেন্স না থাকার পরেও তারা বহাল তবিয়তে ব্যবসা করে যাওয়ার পিছনে আবদুল কুদ্দুসের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার অভিযোগটিও অনেক পূরোনো।