সাড়ে ৩৭ লাখ টাকায় একেকটি পর্দার বিলসহ প্রায় ১৬৬টি চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় সীমাহীন দুর্নীতির ঘটনায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদসহ ১২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থপাচারের অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
রোববার দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে উপপরিচালক মো. সামছুল আলমেন সই করা চিঠিতে তাদেরকে ২৪, ২৫ ও ২৬ নভেম্বর হাজির হতে বলা হয়েছো।
দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে-
দুদক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২৪ নভেম্বর যাদের তলব করেছেন তারা হলেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ, টাঙ্গাইল মেডিক্যাল কলেজের সচিব সাইফুল ইসলাম, কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের স্টোর কিপার মোহাম্মদ সাফায়েত হোসেন ফয়েজ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক মো. শাহজাহান।
২৫ নভেম্বর যাদের তলব করা হয়েছে তারা হলেন রাজশাহী সিভিল সার্জন অফিসের হিসাবরক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান সহকারী মো. আনোয়ার হোসেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টোর কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম, কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের হিসাবরক্ষক আব্দুল মজিদ ও সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ল্যাব সহকারী সুব্রত কুমার দাস।
২৬ নভেম্বর যাদের তলব করা হয়েছে তারা হলেন খুলনা মেডিকেল কলেজের হিসাব রক্ষক মাফতুন আহমেদ রাজা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অফিস সহকারী তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মুজিবুল হক মুন্সি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডব্লিউএইচও) অফিস সহকারী কামরুল ইসলাম।
অভিযোগের বিষয়ে জানা যায়, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটির অব্যবহৃত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) জন্য একটি পর্দা কেনা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে। বর্তমানে যার বাজার মূল্য হবে ২০ হাজার টাকা।
১০ হাজার টাকার ডিজিটাল ব্লাড প্রেশার মেশিন কেনা হয়েছে ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। এভাবে প্রায় ১৮৬ গুণ পর্যন্ত বেশি দাম দিয়ে ১৬৬টি যন্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনিক ট্রেডার্স।
জানা গেছে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্পে এমন দামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স অনিক ট্রেডার্স এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। এর সাথে সে সময়কালে হাসপাতালের শীর্ষ কর্মকর্তারাও সম্পৃক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হাসপাতালের পর্দা ও ব্লাড প্রেশার মেশিনের মতো অব্যবহৃত আইসিইউর জন্য অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্ট কেনা হয়েছে ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
আইসিইউতে রোগীদের কৃত্রিম শ্বাস-প্রসাশ্বের জন্য ব্যবহার করা এ প্ল্যান্ট যদি আমেরিকার তৈরি মেশিন হয় তাহলে সর্বোচ্চ খরচ পড়বে ১ কোটি টাকা। আর যদি জাপানিজ হয় তাহলে খরচ পড়বে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা। আর যদি চাইনিজ হয় তাহলে খরচ কমে আসবে ৪০ লাখ টাকার নিচে।
অনিয়ম দুর্নীতির এখানেই শেষ নয়। হাসপাতালে ভ্যাকুয়াম প্ল্যান্টে খরচ দেখানো হয়েছে ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ প্ল্যান্ট স্থাপনে মেশিনের মানভেদে সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা।
একইভাবে বিআইএস মনিটরিং প্ল্যান্ট স্থাপনে ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ দেখিয়েছে অনিক ট্রেডার্স। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ প্ল্যান্টটির স্থাপনে সবোর্চ্চ খরচ পড়ার কথা ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা।
এছাড়া অনিক ট্রেডার্স প্রতিটি হেড কার্ডিয়াক স্টেথোস্কোপের দাম দেখিয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার টাকা। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে. প্রতি পিস সবচেয়ে ভালো মানের হেড কার্ডিয়াকের দাম সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা।
এসব যন্ত্রপাতি ক্রয় দেখিয়ে ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে মেসার্স অনিক ট্রেডার্স অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে ৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকার ১৬৬টি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। যেখানে প্রকৃত বাজার মূল্য ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৪৬৫ টাকা।
এরই মধ্যে অনিক ট্রেডার্স ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার ৭৩৭ টাকার বিল উত্তোলন করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরো ১০ কোটি টাকার বিল বিভিন্ন অসঙ্গতিতে বিল আটকে দেওয়া হয়।