কুষ্টিয়ার চিতলিয়ার স্কুল দেবদত্ত অপহরণের পর নৃশংসভাবে হত্যার প্রধান দুই আসামি পালিয়ে এখন ভারতে অবস্থান করছে! এরা হলো- কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার চিথলিয়া ইউপি’র চিথলিয়া গ্রামের মালিথা পাড়ার আনছার আলীর ছেলে এরশাদ আলী (৩৩) যার পাসপোর্ট নং-বিএম ০৬০৯৬২৮ এবং একই পাড়ার আমান আলী মুন্সীর ছেলে হাবিবুর রহমান (৩৫) যার পাসপোর্ট নং- বিএম ০৬২৬৫৮৬।
এঘটনায় দেবের বাবা ধুবইল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পবিত্র দত্ত দুই আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য গত ২ জুলাই ভারতীয় হাই কমিশনারের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন। সূত্র জানিয়েছে, পলাতক কিলার হাবিবুর রহমানকে ভারত থেকে অন্যদেশে পাঠানোর উদ্দেশ্যে তার পিতা আমান মুন্সী মাঠের ২২ কাঠা জমি ৫লাখ টাকায় বিক্রি করেছে প্রতিবেশি রইচ উদ্দিনের তিন ছেলের কাছে।
গত ৯ জুন শিশু দেব দত্তকে অপহরণের পর হত্যাকান্ড ঘটিয়ে ১২ জুন কিলিং মিশনের অন্যতম আসামি এরশাদ আলী ভারতে পালিয়ে গিয়ে তাদের ডেরা পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার ধুবলিয়া থানার সিংহাটা গ্রামের মো. বেলাল হোসেনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকেই যোগাযোগ চলে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারি হাবিবুরের সাথে। এরপর হত্যাকান্ডের বিষয়টি জানাজানি হওয়া এবং অপর দুই আসামি আক্কাস আলীর ছেলে জুয়ার ও দীর্ঘদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়ানো জহুরুলের ছেলে নাঈম ২৫ জুন গভীর রাতে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পরই হাবিবুর গা ঢাকা দিয়ে ভারতে পালিয়ে তার দোসর এরশাদের সাথে অবস্থান করছে।
বিষয়টি স্থানীয়দের মাঝে কানাঘোষা শুরু হলে এর ২দিন পর তারা সেখান থেকে পালিয়ে ভারতের কেরলা রাজ্যের একটি জঙ্গী সংগঠনের আশ্রয়ে রয়েছে বলে ঘনিষ্ট সূত্র দাবি করছে।
এসব ব্যাপারে মিরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রফিকুল ইসলাম’র সাথে আলাপ করলে তিনি জানান, আসামি দুইজন দেশের বাইরে রয়েছে সেজন্য আন্তর্জাতিক বিধি মেনে তাদেরকে আটকের প্রক্রিয়া অব্যহত আছে। এছাড়াও হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত ৫ জনের মধ্যে অপর আসামি চিথলিয়া গ্রামের তুফান মল্লিকের ছেলে সবুজ মল্লিক (২৮) ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি শেষে জেল হাজতে রয়েছে।
স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে লোমহর্ষক আলোচিত দেব দত্ত হত্যাকান্ডের ঘটনাটি প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ঘটনার এক মাস পূর্বে প্রতিবেশি আক্কাস আলীর ছেলে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারি জুয়ার ও আমান আলী মুন্সীর ছেলে হাবিবুর রহমান দেব দত্তের সাথে মোবাইলে ভিডিও গেম খেলা ও ফাষ্ট ফুডের বিভিন্ন খাবার দিয়ে তার সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। এরপর পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ জুন সকাল সাড়ে ৭টায় দেব প্রাইভেট পড়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়। আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা হাবিবুর তার নিজের মোটর সাইকেলে হেলমেট পড়ে বসেছিল এবং জুয়ার হেলমেট পড়ে দেবকে মোটর সাইকেলের মাঝখানে তুলে নিয়ে যায় ৪’শ মিটার দুরে হাবিবুরের নিজ বাড়িতে। পরের ঘটনাটি আদিমযুগের বর্বরতাকেও হার মানায়।
৯ বছরের শিশু দেব যখন একটা অস্বাভাবিক অবস্থা বুঝতে পারছিল তখন সে জুয়াড়কে বলছিল কাকু আমিতো পড়তে যাবো। আমাকে ছেড়ে দাও। কিন্তু তার আত্মনাদের একটা শব্দও তাদের মনে কোন দাগ কাটেনি। দেবকে হাবিবুরের শয়ন কক্ষে প্রবেশ করিয়ে কিলিং মিশনের হাবিবুর, জুয়ার, এরশাদ, নাঈম ও সবুজ শলা পরামর্শ শেষে ঘটনার আধ ঘন্টার মধ্যে জুয়ার, নাঈম ও সবুজ ঘরের মধ্যে ঢুকে দেবের হাত পা নাক মুখ চেপে ধরে নরপশুরা তাকে শ্বাসরোধ হত্যা করে। এসময়ে হাবিবুর ও এরশাদ রাস্তায় টহল দিচ্ছিল। লাশটি গুম করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওইদিনই সকাল ১০টায় দেবের নিথর দেহ বস্তাবন্দি করে আমের কাটুনে মধ্যে ঢুকিয়ে পার্শ্ববর্তী নাঈমের বাড়িতে নিয়ে যায়। এবং তার (নাঈম) বাড়ির শৌচাগারে সাপ দেখা গিয়েছে গল্প বানিয়ে নাঈম, সবুজ ও হাবিবুর তিনজনে মিলে এর পাশেই আরেকটি কুয়ো খোঁড়ে।
এরপর আগের কুয়োটির মধ্যে দেবের বস্তাবন্দি লাশটি রেখে দিয়ে মাটি চাপা দেয়। এসময়ের মধ্যে এরশাদ ও জুয়ার মিরপুর উপজেলার নিমতলা বাজারের টাওয়ারের লোকেশনে এসে দেবের বাবা পবিত্র দত্তের কাছে মোবাইল করে ৫০লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করার কিছুক্ষণ পরেই কিলার জুয়ার দেবের পরিবারের সকলের সাথে দেখা করে তাদের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করে।
ইতিমধ্যেই মিরপুর থানা পুলিশ ও স্থানীয়রা দেবকে উদ্ধারে ব্যাপক তৎপর হয়ে উঠে। মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরেই ১১ জুন দুপুরে সিমটির মালিক চিথলিয়ার জুয়েল কে আটক করে থানা পুলিশ। অপহৃত উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত মিরপুর-ভেড়ামারা সার্কেলের এএসপি নূর ই আলম সিদ্দিকীর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে জুয়েল জানায় মোবাইল সেটসহ তার সিমটি চিথলিয়ার হাট থেকে হারিয়ে যায়। পুলিশি ব্যাপক অনুসন্ধান ও দেব পরিবারের সন্দেহের তীরের ফলে হত্যার মাষ্টারমাইন্ড জুয়ার কে আটক করে স্থানীয় থানা পুলিশ। এরমধ্যেই দেবকে উদ্ধারের দাবিতে মিরপুর সহ কুষ্টিয়া জেলার সকল শ্রেনি-পেশার মানুষ প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে। শুরু হয় মানববন্ধন সহ বিভিন্ন কর্মসূচি।
যার ফলে গোটা কুষ্টিয়ার পুলিশ প্রশাসন ব্যাপক অভিযান চালালেও ১৫দিনে এর কোন ইতিবাচক ফলাফল দিতে পারেনা। অবশেষে আটক জুয়ার অপহরণ ও হত্যার সব ঘটনা ২৪ জুনে সকালে খুলে বলে পুলিশের কাছে। কিছু প্রক্রিয়া শেষে ২৫ জুন দুপুর দেড়টায় কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাখাওয়াত হোসেনের নের্তৃত্বে ব্যাপক পুলিশের উপস্থিতিতে নাঈমের বাড়ির শৌচাগারের ১০ফুট গভীরের কুয়োর মধ্য থেকে দেবের বস্তাবন্দি গলিত লাশ উদ্ধার করে। প্রকাশ, পলাতক আসামি এরশাদ ও হাবিবুর দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বৈধ-অবৈধভাবে ভারতে অবস্থান করছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তা জানান, এরশাদ ও হাবিবুর ভারতে একটা জঙ্গী সংগঠনের সাথে যুক্ত রয়েছে। এলাকায় আইন-শৃংখলার অবনতি এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার উদ্দেশ্য নিয়েই এ নৃশংস হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছে।
উল্লেখ্য, ৯ জুন সকালে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার চিথলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির মেধাবী ছাত্র দেব দত্ত (৯) সকাল সাড়ে ৭টায় বাড়ির পাশে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় তাকে অপহরণ করে ৫০লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। দেব উপজেলার চিথলিয়া গ্রামের ধুবইল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পবিত্র দত্তের একমাত্র পুত্র সন্তান।