যশোরের চৌগাছার আদিবাসীদের অস্তিত্ব এখন সংকটাপন্ন। প্রভাবশালী মহল দ্বারা জমিদখল, উচ্ছেদ, নির্যাতনসহ নানাভাবে হয়রারানির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আধুনিক সভ্যতা কিছুটা স্পর্শ করলেও সমস্যায় জর্জারিত হয়ে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে থাকার কারণে তাদের মধ্যে সামাজিক সচেতনা গড়ে ওঠেনি। একই সাথে তাদের মধ্যে নেতৃত্বও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে যে ধারায় অন্যান্য জনগোষ্টি ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেই তুলনায় তারা অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। আর এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে শক্তিশালী জনগোষ্ঠির লোকজন নানাভাবে হয়রানি করছে। মাঝেমধ্যে আদিবাসিরা তাদের অধিকার আদায় ও অন্যায়ের প্রতিবাদে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ করলেও কার্যতঃ কোন ফল পাচ্ছে না। এ অবস্থায় তারা স্বাভাবিক জীবন যাপনে হিমশিম খাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আদিবাসি সাঁওতালরা হলো দ্রাবিড়। এরা যখন ভারত বর্ষে অবস্থান করছিল সেই মহূর্তে অথাৎ ৩৫,০০০ বছর পূর্বে পোল্যান্ড থেকে একদল সভ্য মানবজাতি হিসাবে আর্য নাম ধারণ করে ভারত বর্ষে আগমন করে। এ সময় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কিছু কিছু লোক ওই সভ্য মানবদের সাথে মিশে গিয়ে কিছুটা সভ্যে পরিণত হয়। এছাড়া কথিত আছে এরা সিন্ধু নদের অববাহিকায় অবস্থান করে সিন্ধুর বিকৃত নাম হিন্দু নামে চিহ্নিত হয়ে সমাজের উচ্চস্থানে ঠাঁই নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আদি সংস্কৃতির স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য থেকে তারা তেমন বের হতে পারেনি। পরবর্তীতে ভারতের আসাম রাজ্যেও পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করতে থাকে। বংশানুক্রমে শত শত বছর পাড়ি দেয় আদিবাসি সাঁওতাল সম্প্রদায়।
ইংরেজ শাসনামলে ১৮২৬ সালে ইংরেজগণ চৌগাছার ডাকবাংলার পাশে, চৌগাছার উত্তর-পশ্চিম কোণে তাহেরপুর গ্রামে এবং চৌগাছার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ বর্তমানে কুঠিপাড়া স্থানে খেজুর গাছের রসের গুড় থেকে চিনি তৈরি করার জন্য তিনটি কুঠি তৈরি করে। এই কুঠির শ্রমিক হিসাবে ইংরেজরা ভারতের আসাম রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে ১৮২৭/২৮ সালে তাদেরকে নিয়ে আসে। তখনো কৃষিকাজ তেমন জানত না এরা। শিকার করা তাদের খাদ্য আহরণের প্রাধান্য ছিল। অধিকাংশই প্রাণী কাঁচা অথবা সিদ্ধ করে খেত। তারপর ইংরেজদের পতন হলে কুঠি বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে কেউ কেউ চৌগাছায় আদিবাসীদের অস্তিত্ব সংকটাপন্নতাদের রাজ্যে ফিরে যায়। আবার কেউ এদেশীয় বাসিন্দা হয়ে থেকে যায়। সাঁওতাল সম্প্রদায় যুগে যুগে বহু সংগ্রাম ও গণঅভ্যুস্থানে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে ১৯৫৫ সালে সাঁওতাল যুদ্ধ, ১৯৪৪ সালে ঐতিহাসিক তেঁভাগা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে রাজশাহীর সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ। তাদের বড় বৈশিষ্ট্য হলো সাঁওতাল সম্প্রদায় যত অভাবেই পড়–ক না কেন তারা ভিক্ষা বৃত্তি করে না। ভিক্ষা বৃত্তিকে তারা ঘৃণার চোখে দেখে। শিকার খুব পছন্দের কাজ। শিকারে যাওয়া প্রতিটি আদিবাসি সাঁওতাল পুরুষের বীরত্বের কাজ। শিকারে না গেলে তাকে কাপুরুষ মনে করা হয়।
চৌগাছা অঞ্চলে এখানো তারা শীতের শেষে দলবেঁধে বন, বাঁদাড়ে, সাপ, খরগোশ, বাদুড়, ঈদুর, পাখি ইত্যাদি নানা প্রাণী শিকার করে। প্রতিদিন কাজ শেষে ঘরে ফেরে সন্ধ্যায়। তারপর স্ত্রী, পুত্র সঙ্গে নিয়ে তাড়ি ভাং খেয়ে বিনোদন করে। আর গান গেয়ে আনন্দ উপভোগ করে। গভীর রাত অবধি বিনোদন করে ঘুমিয়ে পড়ে। এমনিভাবে প্রতিদিনের মতই কাজে বেরিয়ে যায়। পুরুষের মত মেয়েরাও বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত। কখনো কৃষিকাজে শ্রম দেয়। কখনো ধান বা অন্যান্য শস্য বা খড়ি কুড়ানোয় ব্যস্ত থাকে। মাঝে মধ্যে ইটের খোয়া ভাংতেও দেখা যায়। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ খুবই সামান্য। এরা দেবতাকে কাজের মধ্যে বেশি স্মরণ করে। এছাড়া পুজা পার্বণে সামর্থ্য অনুযায়ী আনন্দের সাথে উৎসব করে।
বর্তমানে চৌগাছার ঐতিহাসিক আদিবাসি সম্প্রদায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। মাথা গুজবার ঠাই নেই। ছোট ছোট মাটির ঘরে কোন মতে বসবাস করে তারা। বংশ পরাম্পরায় শত বছর ধরে তারা বসবাস করছে। নতুন প্রজন্মের শিশুরা শিক্ষার কিছুটা আলো পেলেও আদিবাসির জনগোষ্টিরা লেখাপড়া জানে না। আদি সংস্কৃতি এখনো তাদের মধ্যে লক্ষ্যণীয়। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তারা নানাভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। প্রভাবশালীরা জাল দলিল করে তাদের জায়গা জমি দখল করে নিয়েছে। দফায় দফায় উচ্ছেদ, ঘরবাড়ি দখলও চালানো হয়েছে। ইতোপূর্বে আদিবাসি পল্লীতে মেয়ে শিশুর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয়েছে। এছাড়া নির্যাতন, মারপিটসহ নানা ঘটনা ঘটেছে। কোন ঘটনার সুষ্ঠু বিচার তারা পায়নি।
খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, আবারও আদিবাসি সম্প্রদায়ের মানুষ সীমাহীন হয়রানির শিকার হচ্ছে। ১০টি অদিবাসী পরিবারকে ক্ষমতার জোরে উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে আদিবাসি সম্প্রদায়ের কয়েকশ নারী-পুরুষ ও শিশু। সরজমিন গেলে, আদিবাসি সম্প্রদায়ের নেতারা বলেন, তাদের পূর্ব পুরুষের ভিটা হিসেবে উপজেলা পরিষদের উত্তর পাশে ১৩২ নং দাগের জমিতে তারা বহুবছর ধরে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করে আসছেন। সরকারের পক্ষ থেকে কখনো তাদের বাঁধা দেয়া হয়নি। ওই দাগে মৃত ভোলানাথ সরদার ও মৃত বন্দিরাম সরদার নামের দুই সহোদরের ১৫ শতাংশ জমি রয়েছে। সেখানে দীর্ঘদিন থেকে ইছাপুর গ্রামের শাহিনুর রহমান ওরফে শাহিন দেওয়ান তাদের বসবাসকৃত সম্পত্তিটি দখল করার পায়তারা করছে বলে তারা অবিযোগ করেন। আদালতের কপি দেখিয়ে সেখানে বসবাসরত সিপন সরদার, বিলু সরদার, ভানু সরদার, তারক সরদার, কার্তিক সরদার, আরতী রাণী সরদার, লক্ষী রাণী সরদারসহ ১০টি পরিবারের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ওই স্থানে বসবাসরত আদিবাসী পরিবারগুলো আদালতের স্মরণাপন্ন হলে মহামান্য আদালত জমিতে ১৪৪ ধারা জারি করেন। তারক সরদার, কার্তিক সরদারসহ আদিবাসীরা আরো বলেন, দখলকারী শাহিনের দাবি, ভোলানাথ সরদারের নিকট থেকে বহু আগে জমিটি ক্রয় করেন, তাহলে সহোদর বন্দিরামের জমিও তারা কি ভাবে দখল করতে আসে। জোর করেই ওই জমিটি হাতাবার জন্য জাল দলিল করে উচ্ছেদ করেছে। ভূমি কমিশনারগণও জাল দলিলের বিষয়টি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এখন কোথায় যাব এমন প্রশ্ন করে অনেকে কেঁদে ফেলেন।
এদিকে বর্ষা মৌসুমের মধ্যে গত ২৪ জুলাই হঠাৎ করেই ১০টি পরিবারকে বসত-ভিটা থেকে উচ্ছেদ করায় তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম অসহায় হয়ে পড়েছেন। মাথা গোজার কোন ঠাই না থাকায় নিন্ম আয়ের এই মানুষগুলো অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। বর্তমানে তারা উচ্ছেদের পর কপোতাক্ষ নদের পাশে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে। সেখানে এখন বর্ষার পানি উঠে নাজেহাল অবস্থা। বলাচলে গৃহবন্দিও মত জীবন যাপন করছে তারা। চোখের পানি সম্বল করে কোন মতে বেঁচে আছে তারা। এ অবস্থায় আদিবাসিরা তাদের জনগোষ্টিকে সংরক্ষণ, নিরাপত্তা ও জমি দখলমুক্তের জন্য সরকারের আশু দৃষ্টি কামনা করেছেন।