নিউ ইয়ার্ক প্রতিনিধি মুনসী মোঃ সাজেদুর রহমান টেনটু-
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম মাধ্যম জনশক্তি রফতানি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক বড় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে। এ খাতে শেষ আশার আলো- মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারও এখন বন্ধ। নতুন বাজার চালু করতে না পারায় জনশক্তি রফতানি খাতে যে অস্থিরতা চলছিল তা এখন আরো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। টালমাটাল এ পরিস্থিতিতে যখন নতুন কর্মী যাওয়ার পথ সীমিত হয়ে আসছে তখন পুরোনো কর্মীদের ফেরত পাঠানোর ঢল নামার শঙ্কাও আছে।
লক্ষাধিক অবৈধ বাংলাদেশিকে ফিরতে হচ্ছে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। এ ছাড়া নির্যাতন এতটাই অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে সৌদি আরবে বাংলাদেশের নারী কর্মী পাঠানোর বিষয়েও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানান উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য নতুন কোনো শ্রমবাজারের দ্বার খোলেনি। ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোর দুয়ার বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বন্ধ। চলতি বছরে বিদেশগামী কর্মীর ৯০ শতাংশেরই গন্তব্য পুরোনো বাজার- মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে। কিন্তু এর মধ্যে সৌদি আরবের নতুন নিয়ম, আমিরাতের ভিসা বন্ধ, কুয়েতের নতুন নিষেধাজ্ঞা, লিবিয়ার অস্থিরতা মধ্যপ্রাচ্যের সংকটকে দীর্ঘায়িত করছে। শুধু মালয়েশিয়ায় সরকারি পর্যায়ে জিটুটি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী প্রেরণই আশার আলো ছড়াচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশি ১০ এজেন্সি সিন্ডিকেট করে মানব পাচারের মাধ্যমে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারের দরজাও শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেলো।
কুয়ালালামপুর থেকে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ কমিটির বৈঠকে ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশের শ্রমিক নিয়োগ বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ১৪ আগস্ট মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টে বিদেশি শ্রমিক ব্যবস্থাপনাবিষয়ক বিশেষ কমিটির ওই বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মালয়েশিয়া গত ২১ আগস্ট বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ২ দেশের সরকারের মধ্যে ২০১৫ সালের ২৬ আগস্টের ঐকমত্য অনুযায়ী শ্রমিক নিয়োগ বা বাতিলের অধিকার মালয়েশিয়ার রয়েছে। সে অনুযায়ী মালয়েশিয়া শ্রমিক নিয়োগ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিয়োগ বন্ধের এ সিদ্ধান্ত ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে। শ্রমিক নিয়োগের বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ২ দেশের মন্ত্রীদের মধ্যে আলোচনার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
মালয়েশিয়া শ্রমিক নিয়োগ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত ২১ আগস্ট বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে বলে স্বীকারও করেছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদার।
বৈদেশিক কর্মসংস্থানে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেশের জন্য যথেষ্ট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ গত কয়েক বছরে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের পরের স্থানটি মালয়েশিয়ার। তাই এ বাজার বন্ধ হওয়াটা দেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান আর রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর বক্তব্যে ধোঁয়াশা
গত ২১ আগস্ট মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল ইন্দেরা খাইরুল দাজমি বিন দাউদ স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে জানানো হয়েছে, দেশটির আগের সরকারের আমলে সিদ্ধান্ত হওয়া বাংলাদেশি ১০টি এজেন্সির বিরুদ্ধে শ্রমিকদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। ফলে বাংলাদেশের যে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি মারফত শ্রমিক নিত, তাদের এসপিএ সিস্টেম ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাতিল বলে গণ্য হবে। উল্লেখ্য, এর সঙ্গে মালয়েশিয়ার আগের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন মালয়েশিয়ার নাগরিকও জড়িত। বর্তমান পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে আর কর্মী নেবে না মালয়েশিয়া।
তবে ২৮ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকায় প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি দাবি করেছেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধের যে খবর বেরিয়েছে তা সঠিক নয়। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়নি। কিন্তু বিদ্যমান প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন। সেপ্টেম্বর থেকে আগের নিয়মেই লোক পাঠানো যাবে আশা প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানায়নি মালয়েশিয়া। প্রকৃত অবস্থা জানতে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনকে দেশটির সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। একটি ‘ভারবাল নোট’ বা চিঠি দেওয়া হচ্ছে। আশা করি খুব শিগগিরই একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
মন্ত্রীর দাবি, মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার এখনো চালু আছে। শুধু পদ্ধতিগত পরিবর্তনের কথা বলছে তারা। এখনো ৩০ হাজার ভিসাসংবলিত অপেক্ষমাণ শ্রমিক আছে। তারা তো বলেনি যে, এরাও যেতে পারবে না। এই ৩০ হাজার শ্রমিক আদৌ শেষ পর্যন্ত যেতে পারবেন কিনা বা এদের পরে আর কোনো ভিসা ইস্যু হবে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তর মন্ত্রী দিতে পারেনি। এক প্রশ্নের জবাবে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘১০ এজেন্সির সিন্ডিকেটের কথা বলা হচ্ছে তা বাংলাদেশ সরকারের নয়, মালয়েশিয়া সরকারের সৃষ্ট। এ বিষয়ে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অভিযোগ জানায়নি।’ মন্ত্রী আরও বলেন, ‘বর্তমান পদ্ধতি বাতিলের বিষয়ে শিগগিরই প্রকৃত অবস্থা জানা সম্ভব হবে। বর্তমান পদ্ধতি বাতিল হলে ১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে অটোমেটিকালি পুরোনো পদ্ধতিতে যাবে। তবে এই পুরোনো পদ্ধতির বিস্তারিত কিছুই জানাননি মন্ত্রী। তাছাড়া মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তিদের বক্তব্যের সঙ্গেও বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর বক্তব্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মন্ত্রীর বক্তব্যে এক ধরনের ধোঁয়াশা