তার নিয়ন্ত্রণে চলে কুষ্টিয়ার ঠিকাদারি
পুরো নাম আমিনুল ইসলাম মুকুল। কিন্তু মুকুল নামেই সবাই তাকে চেনেন। শুধু কুষ্টিয়া নয়, আশপাশের কয়েক জেলায় তার রয়েছে দাপট। কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খাতায় পলাতক শীর্ষ চরমপন্থি নেতা। দেশের বাইরে বসেই ‘রাজত্ব’ সামলান তিনি। ঠিকাদার ও ক্ষমতাসীন দলের কয়েক নেতার সঙ্গে মিলে কুষ্টিয়ার অধিকাংশ সরকারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন মুকুল। রয়েছে নিজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এমনকি হাট-বাজারও রয়েছে তার কবজায়। দীর্ঘদিন বিদেশে পালিয়ে থাকলেও তার রাজত্বে ভাটা পড়েনি। তাই গত ১০ বছরে তার সম্পদ কয়েকগুণ বেড়েছে। গাড়ি-বাড়িসহ নামে-বেনামে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশে অবস্থান করেন মুকুল। কুষ্টিয়ার অনেক রাজনৈতিক নেতা ও ঠিকাদার তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। আবার বিদেশে গিয়ে তার সঙ্গে দেখাও করেন। সম্প্রতি এখানকার তিন নেতা ও ঠিকাদার থাইল্যান্ডে গিয়ে মুকুলের সঙ্গে দেখা করেছেন।
পুলিশ ও একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মুকুলের উত্থান ‘৯০ দশকে। ‘৮৮ সালের দিকে ইসলামিয়া কলেজে এইচএসসি পড়ার সময় শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলনের রাজনীতি শুরু করেন তিনি। সে সময় গোপনে চরমপন্থি বাহিনীও গড়ে তোলেন। ‘৯০ সালের দিকে মুকুল প্রথম পুলিশের হাতে আটক হন। ছাড়া পেয়ে গা-ঢাকা দেন। পরে কিছুদিন সদর উপজেলার ভাদালিয়া এলাকায় নার্সারির ব্যবসা করলেও কুষ্টিয়া ছেড়ে ঝিনাইদহ চলে যান। শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলনের রাজনীতি ছেড়ে গণমুক্তিফৌজ নামে চরমপন্থি সংগঠন গঠন করেন। শাহিন ও লিপটন ছিল তার সেকেন্ড ইন কমান্ড।
এই বাহিনীর মাধ্যমে মুকুল ও শাহিন কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গায় হত্যা, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপকর্ম শুরু করেন। কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীকে হত্যা করে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। মুকুল, শাহিন ও লিপটন মিলে বিএনপি নেতা ভিসি শহীদ ও বাচ্চু, ঠিকাদার জামু ও হাবিব, কুষ্টিয়ার থানাপাড়ার বাবু, কয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা জামিল হোসেন বাচ্চু, ব্যবসায়ী বকুল সওদাগরসহ প্রায় এক ডজন হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এসব হত্যাকাণ্ডের পর দায় স্বীকার করে মিডিয়ায় বিবৃতিও দিতেন মুকুল। এমনকি টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ নিতে সড়ক ও জনপথ অফিসের সামনে তিনজনের কাটা মাথা এবং জি কে অফিসের সামনে দু’জনের কাটা মাথা রেখে আতঙ্ক ছড়ান মুকুল।
জানা যায়, ২০০৫ সালে ক্রসফায়ারের ভয়ে মুকুল, শাহিন ও লিপটন গা-ঢাকা দেন। পরে তারা পালিয়ে ভারতে গিয়ে বনগাঁ এলাকায় ঘাঁটি গাড়েন। ভারতে থেকেই কুষ্টিয়ায় চাঁদাবাজি ও হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকেন মুকুল। ভারতে সুবিধা করতে না পেরে পালিয়ে নেপালে আশ্রয় নেন। সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যও গড়ে তোলেন। পরে অন্য দেশেও যাতায়াত শুরু করেন।
মুকুলের বাড়ি সদর উপজেলার আলামপুর গ্রামে। এসএসসি পাসের পর ভর্তি হন ইসলামিয়া কলেজে। বর্তমানে তার বয়স ৫০। তার বড় ভাই শহীদ কুষ্টিয়া শহরে তার সম্পদ দেখাশোনা করেন। মুকুলের ছেলে সৈকতের নামে তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম সৈকত এন্টারপ্রাইজ। এ প্রতিষ্ঠানের নামে সব ঠিকাদারি কাজ দেখভাল করেন আনোয়ার হোসেন। সম্পর্কে তিনি মুকুলের চাচাশ্বশুর।
গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র জানায়, সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত, এলজিইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ প্রায় সব সরকারি দপ্তরের কাজই দেশের বাইরে বসে নিয়ন্ত্রণ করেন মুকুল। এ জন্য তাকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা ও বেশ কয়েকজন ঠিকাদার সব ধরনের সহযোগিতা করেন। মুকুলের হয়ে কালিশংকরপুর এলাকার ঠিকাদার কালু শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন।
এ ছাড়া সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আবু তৈয়ব বাদশা, শহর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল আলিম, ইবি ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও সদর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজু, একটি উপজেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ক্ষমতাসীন দলের আরও কয়েকজন নেতা মুকুলের হয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন।
স্থানীয় কয়েকজন ঠিকাদার জানান, মুকুলের দাপটের কারণে অনেকে ঠিকাদারি ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো কাজের টেন্ডার আহ্বান করা হলে মুকুল ও তার মনোনীত লোকজন ছাড়া কেউ টেন্ডার জমা দিতে পারেন না। অন্য কেউ কাজ পেলে মুকুলের কাছে কাজ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। এ ছাড়া কোনো ঠিকাদার দরপত্র কিনতে পারেন- এমনটি জানলে মুকুল আগেই তাকে ফোন দিয়ে হুমকি দেন। কেউ দরপত্র কিনে আনলে তার অস্ত্রধারী ক্যাডার ইমনসহ আরও কয়েকজন হুমকি দিয়ে আসে। এ কারণে তারা দরপত্র জমা দেওয়ার সাহস পায় না।
জানা যায়, সপ্তাহখানেক আগে কুষ্টিয়ার জি কে ঘাট থেকে শ্মশান পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ কাজের সিডিউল মুকুলের প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কেউ জমা দিতে পারেনি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০০ কোটি টাকার কাজেও মুকুলের নজর পড়েছে। যুবলীগ-ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকে দিয়ে এ কাজ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন তিনি। শুধু আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারাই নন, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারাও মুকুলকে সহযোগিতা করে আসছেন। তারা মুকুলের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মুকুল বেশিরভাগ সময় মালয়েশিয়া থাকেন। মাঝেমধ্যে থাইল্যান্ড যান। নেপালে তার ব্যবসা এখনও রয়েছে। এখন তিনি লম্বা দাড়ি রেখেছেন। জুব্বা পরেন।
কুষ্টিয়া শহরের গোশালা রোডে তার দুটি আলিশান পাঁচতলা বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া বটতৈল মোড় ও ভাদালিয়ায় বাড়ি রয়েছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় তার ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় তার কমপক্ষে ১০টি ফ্ল্যাট আছে। কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন ব্যাংকে স্বজনের নামে তিনি টাকা রেখেছেন। দেশের বাইরে বিপুল টাকা পাচার করেছেন। এ ছাড়া মুকুলের নামে বিভিন্ন থানায় হত্যা, চাঁদাবাজি ও অপহরণের একাধিক মামলা রয়েছে।
মুকুলের ভাই শহীদ বলেন, আমি যে সম্পদগুলো দেখভাল করছি, তার সবই আমার ভাইয়ের। তিনি দাবি করেন, বাড়ি থেকে শুরু করে সব সম্পদ বৈধ উপায়েই অর্জন করা হয়েছে।
সৈকত এন্টারপ্রাইজের বিভিন্ন কাজ দেখভালের দায়িত্বে থাকা আনোয়ার হোসেন বলেন, মুকুলের নির্দেশনা অনুযায়ী আমি কাজ করি। প্রভাব খাটিয়ে কাজ নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কীভাবে কাজ পায় তা জানি না। আমি শুধু নির্দেশনা পালন করি।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনও টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি করিনি। কেউ দলের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসীর সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে অপকর্ম করলে তার দায় দল নেবে না। তিনি আশা করেন, যারা এ ধরনের অপকর্ম করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত বলেন, মুকুল তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তবে দীর্ঘদিন ধরে পলাতক। তার নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসী ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ জেলায় টেন্ডারবাজ, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজের স্থান নেই। পুলিশ এক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স। সূত্র- সমকাল