নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা দেখিয়েছেন চাইলে সবকিছু নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলতে পারে। ঢাকার সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা, অবৈধ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে তারা সবার টনক নড়িয়েছেন। তাদের দেখানো পথে এখন হাটছে মানুষ। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সেই ধারাবাহিকতায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীও তৎপর হওয়ায় বিআরটিএতে গাড়ির ফিটনেস সনদ ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন এবং নতুন লাইসেন্স সংগ্রহের হিড়িক পড়েছে।
অন্য সময়ের চেয়ে বর্তমানে দ্বিগুণের বেশি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন জমা পড়েছে। একই সময়ে গাড়ির ফিটনেসের জন্য আবেদন জমা পড়ছে দেড়গুণ। সরকারি এ সংস্থাটির পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় এসব সেবা পেতে প্রচণ্ড ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা। কাঙ্খিত সেবা পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
লাইসেন্স কাউন্টারে দীর্ঘ সারি
সরেজমিনে বিআরটিএ সার্কেল-১ কার্যালয়, মিরপুরে গিয়ে দেখা যায় উপচেপড়া ভিড়। গাড়ি আর লোকজনের সমাগমে স্বস্তিতে দাঁড়ানোর মতো জায়গা নেই। প্রাইভেটকারের লাইনের লেজ গিয়ে ঠেকেছে পুলিশ কনভেনশন সেন্টারের সামনে। আর ভেতরে মোটরসাইকেলসহ অন্য গাড়ির জন্য চলাচল করাই কষ্টসাধ্য। লাইসেন্স পাবার কাউন্টারেও লম্বা লাইন তৈরি হয়েছে। এ লাইন ভবনের বাইরে পর্যন্ত চলে যায়।
বিআরটিএর’র সহকারী পরিচালক (লাইসেন্স) আলী আহসান মিলন বলেন, আগের চেয়ে সেবা নিতে আসা গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা ও মেয়াদ বৃদ্ধির জন্যই বেশি গ্রাহক আসছেন। এছাড়া লাইসেন্স নবায়ন, নতুন লাইসেন্স গ্রহণ, স্মার্টকার্ডের জন্য বায়োমেট্রিক গ্রহণ, ডিজিটাল নম্বর প্লেট গ্রহণ, গাড়ির রেজিস্টেশন, মালিকানা পরিবর্তন ও নতুন লাইসেন্সের আবেদনের সংখ্যা বাড়ছে।
তিনি বলেন, আগে প্রতিদিন ৮ থেকে ৯ শ’ গাড়ি ফিটনেসের জন্য আনা হতো। বর্তমানে ১২শ’ থেকে ১৪ শ’ গাড়ি ফিটনেসের জন্য আসছে। আমাদের দশজন পরিদর্শক গাড়ির ফিটনেস চেক করছেন। এসব গাড়ির ফিটনেস প্রতিদিনেরটা প্রতিদিন দেখা হচ্ছে। আমাদের নির্ধারিত জনবল দিয়েই এই ভিড় সামলানো হচ্ছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, ড্রাইভিং লাইসেন্সের সরকারি ফি ৩ হাজার ৫০০ টাকা। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে ছয়-সাত মাস সময় লাগে। শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স করার ছয় মাস পর ব্যবহারিক পরীক্ষার তারিখ দেয়া হয়।
ব্যাংকেও দীর্ঘ সারি
লাইসেন্স ফি জমা নেয়া ব্যাংক কাউন্টারেও দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকে টাকা জমা দিতে পারেনি। গাড়ির লাইসেন্স পাওয়ার অপেক্ষায় তাই কড়া রোদের মধ্যেই ঘণ্টার ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। ব্যাংকে টাকা জমার চারটি লাইন তৈরি হয়েছে। প্রতিটি লাইনে সহস্রাধিক মানুষকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
যাত্রাবাড়ী থেকে গাড়ির লাইসেন্স নবায়ন করতে এসেছেন রাকিবুল ইসলাম। সকাল ১০টায় ব্যাংকে নবায়ন ফি জমা দিতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। বেলা ২টা বাজলেও ২০ জনের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, লাইসেন্স নবায়ন করতে সকালে এসেছি। এখন দুপুর হয়ে গেছে, এখনও ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে রশিদ নিতে পারিনি। গতকাল মঙ্গলবার এসে লম্বা লাইন দেখে ফিরে গেছি। তাই আজ সকাল সকাল এলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
মোহাম্মদপুর থেকে এসেছেন মুজাহিদ খান। গত তিন মাস আগে বাইক কিনলেও এখনও ড্রাইভিং লাইসেন্স করেননি। বর্তমানে ট্রাফিক আইন কড়াকড়ি হওয়ায় ঝামেলা এড়াতে তিনি এসেছেন লাইসেন্স করতে। কিন্তু দিন পার হয়ে গেলেও ব্যাংকের লাইন শেষ হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
তৎপর দালালরা
লাইসেন্স প্রাপ্তির আবেদনের হিড়িকের সঙ্গে দালালদের তৎপরতাও বেড়েছে। মঙ্গলবার সরেজমিন দেখা যায়, বিআরটিএ মূল ফটকের বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তিন-চারজনের ছোট ছোট জটলা। কার্যালয়ের ভেতরে বিভিন্ন কক্ষের আশপাশ, ব্যাংকসহসর্বত্র দালালরা তৎপর। মূল ফটকের পাশে স্ট্যাম্প, ফটোকপির দোকানগুলো তাদের মূল আস্তানা। নতুন কেউ এখানে এলেই তাদের কাজ করার প্রস্তাব দেন দালালরা।
সেবা নিতে আসা লোকজন অভিযোগ করেন, সাধারণ প্রক্রিয়ায় সেবা পেতে অযথা হয়রানি করা হচ্ছে। অথচ দালালদের দিয়ে দ্রুত কাজ হয়ে যাচ্ছে। আনসার বাহিনীর কাছ থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন সাত-আটজন দালাল ধরছেন তারা। অনেকে দালালের খপ্পরে পরে সর্বশান্ত হয়ে ফিরছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিআরটিএর ঢাকা বিভাগের বিআরটিএর উপপরিচালক মো. মাসুদ আলম বলেন, আমরা কোনো দালাল প্রশ্রয় দিচ্ছি না। কেউ দালালের তৎপরতা দেখলে তাকে পুলিশে সোপর্দ করার জন্য বলা হয়েছে।
জনবল সংকটে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিআরটিএ
বিআরটিএ’র জনবল সংকটে সংস্থাটির কার্যালয়ে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এক অফিসের জনবল দিয়ে আরেক অফিস চালানো হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির একজন ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ সময়ে সেবাগ্রহীতাদের যে ভিড় থাকে তা সামাল দিতেই হিমশিম খেতে হয়। চলতি সপ্তাহে চাপ বেড়েছে অনেক বেশি। ফলে আমাদের লোকজন হিমশিম খাচ্ছে।
বিআরটিএর’র সহকারী পরিচালক (লাইসেন্স) আলী আহসান মিলন বলেন, এই সেবা দিতে অতিরিক্ত জনবল সংযুক্ত করা হয়নি। প্রতিদিন যারা আসবেন তাদের সেবা দেওয়া হবে। কাউকে ফেরত দেয়া হবে না। প্রয়োজনে অফিস টাইমের পরেও কর্মকর্তারা কাজ করবেন।
বিআরটিএ অফিস সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা
যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয়া ও নবায়ন, চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া ও নবায়নসহ জরুরি সেবা দিতে সারা দেশের বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) অফিস সপ্তাহের শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার ৬ দিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
মঙ্গলবার (৭ আগস্ট) এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এটা অব্যাহত থাকবে।
হঠাৎ বিআরটিএ অফিসে ওবায়দুল কাদের
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হঠাৎ মিরপুর বিআরটিএর কার্যালয় পরিদর্শনে যান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সেখানে তিনি বলেছেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চলবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দালালদের দৌরাত্ম একদিনে বন্ধ হবে না। ক্রমান্বয়ে বন্ধ হবে। এ সময় তিনি বিআরটিএ কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতার সঙ্গে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার নির্দেশ দেন।