সরকারি নির্দেশনার অপপ্রয়োগ, মিটার না দেখেই গড়বিলের নামে পুকুরচুরি
কুষ্টিয়ার খোকসার হাসিমপুর গ্রামের দরিদ্র কৃষক শহিদুল ইসলাম। করোনার কারণে দু‘বেলা পেট পুরে খেতে পারেন না। তারউপর এ মাসে (এপ্রিল) বিদ্যুৎ বিল এসেছে ৯৪৩ টাকা। অথচ গত মার্চেও তার বাড়ির বিদ্যুৎ এসেছিল ৩২৮ টাকা।
বিদ্যুৎ বিল দেখে তার পিলে যেন চমকে ওঠে। স্থানীয় একজনের সহায়তা তিনি বিগত কয়েকমাসের বিলের কাগজ নিয়ে আসেন তড়িঘরি করে চলে আসেন উপজেলা সদরের সাব-জোনাল অফিসে। এসে দেখেন এ সমস্যা শুধু তার একার নয়- হাজারো মানুষের।
অনেকেই সাব-জোনাল অফিসের কর্তাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বিতণ্ডায়! বিদ্যুৎ অফিসের সামনেই তার সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ অফিসের মিটার রিডাররা করোনার কারণে মিটার দেখতেই যাননি। অথচ তারা মিটারের রিডিং না দেখেই অনুমানেই ১০৫ রিডিং বেশি দেয়।
এত বিল কোনোদিন আসেনি বলে অভিযোগ এই গ্রাহক বলেন, এমনিতে আমার আয়-রোজগার বন্ধ তারউপর এত বিল কীভাবে দিব?
গড়বিলের নামে দ্বিগুন বিল!
একই সমস্যা উপজেলার প্রতিটি গ্রাহকেরই। রিকশাভ্যান চালক আনারুল খাঁ বলেন, আমার কয়েক মাসের চেয়ে এবারের বিল অনেক বেশি এসেছে। আমি অফিসে এসে জানালে তারা বলে- এটা সরকারের নির্দেশ। তাদের কিছুই করার নেই।
এদিকে, দেশে চলছে মহামারি করোনা ভাইরাস। আর এই মহামারিতেই পল্লী বিদ্যুৎতের মহামারি কাণ্ডে হতবাক প্রতিটি গ্রাহক।
বিলের তারতম্য দেখে সাব-জোনাল অফিসে ছুটে আসেন প্রবাসী মিথুন সামি। তিনি বলেন, তারা (পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ) মিটার না দেখেই অফিসে বসে ইচ্ছেমত হাঁকিয়েছে বিল! এটা কী কোনো সভ্য দেশের কাণ্ড হতে পারে।
মাহবুব হাসান শিপন বিল দিয়েছেন গত শনিবার (২৫ এপ্রিল)। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিলের আকাশ-পাতাল তফাৎ দেখে আমি ছুটে যাই অফিসে। অফিসে গিয়ে আমি মিটারের রিডিং দেখিয়ে বিল সমন্বয় করে এসেছি। একটি স্বাধীন দেশে এরকম প্রকাশ্য দুর্নীতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
পল্লী বিদ্যুতের সাব-জোনাল অফিসের সামনেই ভুয়া বিলের প্রতিবাদ করে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন কয়েকশ গ্রাহক। বিক্ষাভকারী গ্রাহকরা বলছেন- এ যেন পুকুরচুরি নয়, রীতিমত সাগরচুরি!
জানা গেছে, সরকারি নির্দেশনার ধুয়োতুলে বিল গড়বিল করে বাড়তি টাকার চাপ দিচ্ছে গ্রাহকের ঘাড়ে। করোনা ভাইরাস আক্রান্তের আশংকায় পল্লী বিদ্যুৎ মিটার রিডিং কর্মীরা মাঠপর্যায়ে প্রকৃত রিডিং সংগ্রহ না করে গড়বিল করার কারণে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলের বোঝা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত যে মিটারের ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিল ছিল ২৪৫ ইউনিট। সেই মিটারেই একই সময়ে গড় ব্যবহৃত বিদ্যুৎ ধার্য্য করা হয়েছে ৪০৪ ইউনিট! যা কিনা এই মিটারটির এ যাবৎ ব্যবহারিত সর্বোচ্চ ইউনিট থেকেও অনেক বেশি।
এর ফলে বিল নির্ধারণ ধাপ অনুযায়ী পঞ্চম ধাপে প্রতি ইউনিট ৯ টাকা ৯৪ পয়সা হিসেবে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা বাড়তি এবং বাড়তি ভ্যাট গ্রাহকের ঘাড়ে চেপে বসেছে।
বিদ্যুৎ বিলের সমিকরণ হিসেবে প্রকৃত ব্যবহৃত ইউনিট ২৪৫ এর বিল আসে ৩য় ধাপ পর্যন্ত। আর প্রথম ধাপে হিসাব করা হয় ৭৫*৪.১৯ টাকা, দ্বিতীয় ধাপে ১২৫*৫.৭২ টাকা, আর তৃতীয় ধাপে ৪৫*৬ টাকা ২৪৫ ইউনিটের বিল ১৩২৯ টাকা ও ভ্যাট ৬৭ টাকা। আর ৪র্থ ধাপে ১০০*৬.৩৪ টাকা এবং ৫ম ধাপ= ৪*৯.৯৪ টাকা
উপরের সমীকরণ অনুযায়ী গড়বিল ৪০৪ ইউনিট ধার্য্য করার ফলে বিল চলে যায় পঞ্চম ধাপে। পঞ্চম ধাপের সমীকরণে মোট ইউনিট ৪০৪ এর বিল আসে ২ হাজার ৩৩৩ টাকা সাথে ১১৭ টাকা ভ্যাট।
অথচ গ্রাহকের প্রকৃত ব্যবহার ২৪৫ ইউনিট। কিন্তু সে একদম অনৈতিকভাবে ৪০৪ ইউনিট ধার্য্য করায় ৪র্থ ধাপের ৬.৩৪ টাকা ও ৫ম ধাপের ৯.৯৪ পয়সা হারে অতিরিক্ত টাকার সঙ্গে অতিরিক্ত ভ্যাট অনৈতিক ভাবে গ্রাহকের উপরে চাপিয়ে তা আদায়ের চেষ্টা করছে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ।
দেশের এই কঠিন সংকটের মুহূর্তেও জনগণকে ভর্তুকি দেওয়ার পরিবর্তে সরকারি নির্দেশনার ধুয়োতুলে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের চেষ্টা করছে পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড।
এ ব্যাপারে কথা হয় পল্লী বিদ্যুতের খোকসা সাব-জোনাল অফিসের এজিএম ওমর আলীর সঙ্গে। তিনি গ্রাহকদের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সরকারেই নির্দেশেই এমনটি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তার কিছু করার নেই।