পাড়ায়-পাড়ায় সংঘাত, খুনোখুনি ঘটছে প্রতিদিন। বাসার ভেতরে শিশু খুন হচ্ছে। রাস্তায় ছিনতাইকারীর হাতে প্রাণ যাচ্ছে। বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন হচ্ছে। তুচ্ছ ঝগড়া থেকে মারামারি, ছুরিকাঘাত, খুনোখুনি। হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম নগরী।
তদন্ত করে পুলিশ তথ্য পাচ্ছে, প্রায় প্রতিটি ঘটনায় জড়িত এক বা একাধিক কিশোর কিংবা উঠতি বয়সের তরুণ। অশিক্ষিত -বখাটে কিশোর-তরুণ থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের ছাত্ররাও জড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর অপরাধে। পাড়ায়-পাড়ায় গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। তাদের হাতে হাতে ছোরা-অস্ত্র।
এদের পেছনে আছে কথিত ‘বড় ভাই’। এরাই কিশোর এবং উঠতি বয়সের তরুণদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছেন। এসব বড় ভাই আবার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, কারও পদ-পদবি আছে, কেউ বা আবার পদবিহীন স্বঘোষিত। কিন্তু কথিত ‘বড় ভাইয়েরা’ সবাই ক্ষমতাধর। এদের অনেকেই সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত।
বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের পর চট্টগ্রাম নগর পুলিশ এবার কথিত এসব বড় ভাইদের কার্যক্রম নজরদারিতে রাখতে তাদের তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বড় ভাইদের ক্ষমতা খর্ব করে কিশোর-তরুণদের তাদের দল থেকে বের করে আনতে পারলে অস্থিরতা কমবে বলে মনে করছে পুলিশ।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কমিশনার মো.মাহবুবর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘বড় ভাই-ছোট ভাই এটা বড় বিষয় নয় অপরাধীদের ধরাই মূল বিষয়। এখন অপরাধীরা যাদের শক্তিতে অপরাধ করে তাদেরও আমরা চিহ্নিত করছি। তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাব। রাজনৈতিক পরিচয়ে কেউ ছাড় পাবে না।’
কথিত বড় ভাই এবং তাদের দলভুক্ত কিশোর-তরুণদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি শহরের মূল অংশে। চট্টগ্রাম নগরীর কোতয়ালী, পাঁচলাইশ, চকবাজার, বাকলিয়া, ডবলমুরিং, সদরঘাট, বন্দর, হালিশহর, চান্দগাঁও থানার বিভিন্ন এলাকা জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিশোর-তরুণ অপরাধীরা।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মো. আব্দুল ওয়ারিশ খান জানান, ‘শুধুমাত্র দল ভারি করার জন্য, শোডাউন দেয়ার জন্য এবং নিজের নামে স্লোগান দেয়ানোর জন্য তথাকথিত কিছু লোক বড় ভাই সেজে বসে আছেন। কিশোর কিংবা উঠতি বয়সের তরুণ যারা আছে তারা কথিত বড় ভাইদের সাথে গিয়ে ছবি তোলেন, সেটা ফেসবুকে দেন। এক ধরনের হিরোগিরির নেশার মতো। তারা মনে করে, ভয়ঙ্কর কোন অপরাধ করলেও বড় ভাই তাদের বাঁচাবে। নগরীতে এখন একের পর এক অপরাধ যেগুলো হচ্ছে প্রায় সবই এই বড় ভাই সংস্কৃতির সৃষ্টি।’
ওয়ারিশ বলেন-‘আমরা যেটা করছি, অপরাধ সংঘটনের পর জড়িতদের ছাড় দিচ্ছি না। সেই জড়িতদের বড় ভাই হিসেবে তদন্তে আমরা যাদের নাম পাচ্ছি, তাদের নাম রেকর্ডে নিচ্ছি। থানাগুলোতে তালিকায় বড় ভাইদের নাম উঠে যাচ্ছে। তাদের কার্যক্রম নজরে রাখা হচ্ছে। তারা অপরাধ করলে তাদেরও ধরা হবে।’
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসেন জানান, ‘যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলোতে কথিত বড় ভাইয়ের লিংকটা আমরা সরাসরি পাচ্ছি না। এমন না যে, বড় ভাইদের নির্দেশেই খুনোখুনি হচ্ছে। কিন্তু পরোক্ষভাবে কথিত বড় ভাইরাই দায়ী। কারণ তাদের ছায়া পেয়েই বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর-তরুণরা। এখন ঘটনার পর যখন কিশোর-তরুণরা গ্রেপ্তার হয়ে যাচ্ছে, তারা যখন বুঝতে পারছে বড় ভাই বাঁচাতে পারবে না, তারা জেল থেকে বের হওয়ার পর আর বড় ভাইয়ের কাছে যাবে না। এই কথিত বড় ভাইরা দুর্বল না হওয়া পর্যন্ত এই অস্থিরতা দমন করা যাবে না।’
সম্প্রতি নগরীর কোতয়ালী থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ দমনে প্রতিদিন সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছেন মোহাম্মদ মহসিন। কিশোর-উঠতি বয়সী তরুণদের আড্ডাস্থল চিহ্নিত করে সেখানে পুলিশ আচমকা হানা দিচ্ছে।
ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আটকের পর তারা যেসব বড় ভাইদের পরিচয় দিচ্ছে, সেসব বড় ভাইদের নাম আমরা তালিকাভুক্ত করছি। আমার থানা এলাকায় কারা কিশোর অপরাধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে সেটার তথ্য আমরা সংগ্রহ করছি। কথিত বড় ভাইদের ছাড় দেয়া হবে না।’