কাজীদের নিয়ে কর্মশালায় শপথ
তথ্য গোপন করে বাল্য বিয়ে পড়ালে তাৎক্ষনিক জেল জরিমানা
উপযুক্ত প্রমান ও জন্ম নিবন্ধন ছাড়া জেলার কোথাও একটি বিয়ে না পড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার (কাজীরা)। একই সাথে তারা ওয়দা করেন আগামী জুনের মধ্যে জেলাকে বাল্যবিয়ে মুক্ত করা হবে। আর কোন কাজী বাল্য বিয়ে পড়ালে তাকে কঠোর আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এ সময় কাজীরা হাত তুলে জেলা প্রশাসকের সামনে ওয়াদা করেন তারা আজকের পর থেকে একটিও বাল্য বিয়ে পড়াবেন না।
গতকাল রোববার সকালে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা নিকাহ্ রেজিষ্ট্রারদের নিয়ে এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধকল্পে নিকাহ রেজিষ্ট্রারদের ওই কর্মশালায় জেলার অন্তত শতাধিক নিকাহ রেজিষ্ট্রার উপস্থিত ছিলেন।
আদালত চত্বরে বাল্য বিয়ে হচ্ছে। নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে বয়স বাড়িয়ে বাল্য বিবাহ দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলার নিকাহ রেজিষ্ট্রারেরা। এ জন্য কাজীদের পাশাপাশি যারা আদালত চত্বরে অবৈধ বিয়ে পড়াচ্ছে তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি করেন কাজীরা।
জেলা রেজিষ্ট্রার কার্যালয়ের আয়োজনে জেলা রেজিষ্ট্রার মনিরুল হক প্রধানের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোঃ আসলাম হোসেন।
কর্মশালায় নিকাহ রেজিষ্ট্রারেরা হাত উচিয়ে অঙ্গীকার করেন, আজ থেকে কোন বাল্যবিবাহ রেজিষ্ট্রি করবেন না। এবং আগামী তিন মাসের মধ্যে জেলাকে বাল্য বিবাহমুক্ত ঘোষণা করবেন।
সভায় জেলার ৬ উপজেলার কাজী সমিতির ছয়জন নেতা বক্তব্য দেন। তারা অভিযোগ করেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বাল্য বিবাহ দেওয়ার জন্য চাপ ও ভয়ভীতি দেখায়। গ্রামের দরিদ্রশ্রেনীর বাবা-মা তাদের সুন্দরী মেয়েদের বখাটেদের ভয়ে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেন। সেক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না। আবার মহিলা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, টাকার লোভে কাজীরা বাল্য বিয়ে পড়াচ্ছেন। তারা তথ্য লুকিয়ে এসব কাজ করছেন। তারা নিকাহ রেজিষ্টার বই পর্যন্ত নকল করছেন। গত এক বছরে জেলায় শতাধিক বাল্য বিয়ে বন্ধ করা হয়েছে বলে তথ্য তুলে ধরা হয়। এ জন্য গ্রাম পুলিশরা বড় ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া বাল্য বিয়ে পড়ানোর অপরাধে গত এক মাসে তিন কাজীকে জেল জরিমানা দেয়া হয়েছে বলে কর্মশালায় তথ্য তুলে ধরা হয়।
সবচেয়ে বড় সমস্যা বর্তমানে আদালত চত্বরে প্রতিদিনই নোটারী পাবলিকে বয়স বাড়িয়ে অহরহ বাল্য বিয়ে হচ্ছে। এবং সেটা কখনোই নিকাহ রেজিষ্ট্রি করানো হচ্ছে। এটা না ঠেকানো গেলে বাল্য বিবাহের হার কোনভাবেই কমানো যাবে না।
তবে সদর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মর্জিনা খাতুন প্রমাণসহ উল্লেখ করে বলেন, কতিপয় নিকাহ রেজিষ্ট্রারের কাছে একাধিক ভুয়া রেজিষ্ট্রি বই থাকে। সেখানে সই স্বাক্ষর ছাড়াই বিয়ে দেওয়া হয়। বাল্য বিয়ের সাথে কিছু নিকাহ রেজিষ্ট্রারও জড়িত থাকে।
তিনি আরও বলেন, নিকাহ রেজিষ্ট্রার, ইউপি চেয়ারম্যান বা সদস্যরা কেউই বাল্য বিবাহের ব্যাপারে কোন খোঁজখবর দেয় না। তারা সচেতন হলে কোনভাবেই বাল্য বিবাহ হতে পারে না।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ভেড়ামারা উপজেলার এক নিকাহ রেজিষ্ট্রার বলেন, ‘পোড়াদহ ইউনিয়নের নিকাহ রেজিষ্ট্রার ইয়ার আলী প্রতি বছর এক হাজারের অধিক বিয়ে পড়ান। বিভিন্ন উপজেলার মানুষ গিয়ে তার কাছে বিয়ে রেজিষ্ট্রি করে। অথচ আমি প্রতি মাসে এক’শ বিয়েও রেজিষ্ট্রি করতে পারি না।’
ইয়ার আলীর বিরুদ্ধে সভায় অভিযোগ উঠলে তাকে দিয়েই বাল্য বিবাহ রেজিষ্ট্রি না করার অঙ্গীকার করানো হয়। ইয়ার আলী বলেন, তিনি আর কোন বাল্য বিবাহ করাবেন না। বরং প্রতিরোধে কাজ করবেন।
সভায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আজাদ জাহান বলেন, জন্ম নিবন্ধন ছাড়া কোনভাবেই বিয়ে দেওয়া যাবে না। জন্ম নিবন্ধন সঠিক কি-না সেটা যাচাইয়ের জন্য যেকোন সময় সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বা চেয়ারম্যানকে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হয়ে নেবেন। এটা করতে খুব বেশি সময় লাগে না। আর কোন কাজীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তাৎক্ষনিক জেল জরিমানা দেয়া হবে।’
প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে কোন বিবাহ দেবার বিধান নেই। আদালত চত্বরে বিয়ে না করানোর ব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ে কঠোরভাবে চিঠি লেখা হবে। কোনভাবেই প্রভাবশালীদের চাপের মুখে নত হবেন না। যেকোন প্রয়োজনে প্রশাসনকে জানাবেন। আর ইউপি চেয়ারম্যান বা সদস্যদেরকেও কঠোর বার্তা দেওয়া হবে। আজ থেকে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হল। আগামী তিন মাসের মধ্যে যে কোন মুল্যে জেলাকে বাল্য বিয়ে মুক্ত করার ঘোষনা দেন জেলা প্রশাসক। এ জন্য তিনি কাজীসহ সবার সহযোগিতা চান।