ঘুষ নেওয়ার দায়ে কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিস্ট্রার গ্রেপ্তারের পর পুরোপুরি অচল হয়ে গেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা এই ভূমি নিবন্ধন অফিস।
জেলার বটিয়াঘাটা থেকে সদরে বদলির হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে গত ৭ নভেম্বর সাব রেজিস্ট্রার সুব্রত কুমার সিংহ রায়কে অভিযান চালিয়ে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। এরপর থেকে সাব রেজিস্ট্রারের অফিসের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
সদর উপজেলায় সাব-রেজিস্ট্রার পদে কেউ না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে এ অফিসের অবস্থা নাজুক বলেও জানিয়েছেন কুষ্টিয়া জেলা রেজিস্ট্রার প্রভাকর সাহা।
অন্য অফিস থেকে এসে সপ্তাহে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে দুই থেকে তিন দিন দলিল নিবন্ধনের কাজ করতেন সাব-রেজিস্ট্রাররা বলে জানান তিনি।
সাব রেজিস্ট্রার না থাকা ছাড়াও নানান ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ রয়েছে।
সদর সাব রেজিস্ট্রারের অফিসে এসে মাঝে দায়িত্ব পালন করা মিরপুর উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, “এখানকার অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনার বিষয়ে ভুক্তভোগী দলিল দাতা/গ্রহীতার অভিযোগের পেক্ষিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে মনিটরিং-এর উদ্যোগ নেওয়া হলেও এর টেকসই কোন সুফল পাওয়া যায়নি।”
“২০১০ সালে সাব-রেজিস্ট্রার হেলেনা খাতুনের পর যারা এসেছেন তারা সেখানে ‘টিকতে পারেননি’।”
সর্বশেষ স্থায়ী পোস্টিংপ্রাপ্ত সাব রেজিস্ট্রার নুর মহম্মদ শাহ ১৭ মাস কাজ করার পর ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন বলে জানান তিনি।
কুষ্টিয়া জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ সমন্বিত টাস্কফোর্স কমিটির সহ-সভাপতি এসএম কাদরী শাকিল বলেন, জেলার বার্ষিক শত কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের প্রতিষ্ঠান- জেলা রেজিস্ট্রি অফিস কিন্তু প্রায় এক দশকেও গুরুত্বপূর্ণ এ দপ্তরে দুর্বৃত্তায়নের রাহুমুক্ত হচ্ছে না।
“সীমাহীন দুর্নীতি আর অনিয়মের ভোগান্তি এখানে নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তবে সেবাগ্রহীতারা দলিল লেখকদের মাধ্যমে দলিলটা তৈরি করেন উল্লেখ করে জেলা রেজিস্ট্রার প্রভাকর সাহা দাবি করেন, “এই দপ্তরের কারো সঙ্গেই অবৈধভাবে কোনো টাকা লেনদেনের সুযোগ নেই। লেনদেন যা করেন তা সবই অফিসের বাইরে থেকে করেন।”
‘একটি চক্র’ সেখানকার কর্ম পরিবেশ নষ্ট করার নষ্ট উল্লেখ দাবি করে। তিনি আরও জানান, বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
সম্প্রতি এই সাব রেজিস্ট্রারের অফিসে দলিল নিবন্ধন করা কয়েকজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে।
এদের একজন- কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঝাউদিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল মাজেদ প্রামাণিক বলেন, জিম্মিদশা জেনেও জমি বা সম্পত্তি হস্তান্তরে প্রয়োজনীয় দলিল সম্পাদনে আমরা রেজিস্ট্রি অফিসে যেতে বাধ্য হচ্ছি।
“যেহেতু দলিল লেখক সমিতির সদস্য ছাড়া সরাসরি সাব রেজিস্ট্রারের এজলাসে গিয়ে দলিল সম্পাদনের কোন সুযোগ নেই। যা কিছু করার সব দলিল লেখকরা করেন।
“আমরা শুধু ওদের অফিস খরচসহ নানা খাত দেখিয়ে দাবিকৃত টাকা দিয়ে কাজ শেষ করি।”
দলিল সম্পাদনে জন্য দুই লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করার দাবি করে সদর উপজেলার মিনাপাড়া এলাকার হোসনেয়ারা বেগম ও এমএ খালেক জানান, দলিল লেখক তাদের স্বাক্ষরসহ সবকিছু ঠিক করে এজালাসের সামনে দাঁড় করালেন, কিছুক্ষণ পর এক জায়গায় টিপসই নিয়ে আমাদের বললেন-কাজ শেষ।”
জগতি এলাকার নজরুল ইসলাম বলেন, অফিসের সামনে বোর্ডে যে সরকারি ফি লেখা আছে সেই টাকায় কেউ কাজ করতে রাজি হয়নি।
তার কাছে একটি দলিলের সার্টিফাইড কপি উত্তোলনে ১৫শ টাকা এবং অন্য একটি দলিল অনুসন্ধানে ৫০০ টাকা নিয়েছে বলে জানান তিনি।
সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে অনুমোদিত সনদধারী প্রায় ৪২ সদস্যের দলিল লেখক রয়েছেন বলে জানান কুষ্টিয়া জেলা রেজিস্ট্রারের অফিসের প্রধান সহকারী লিয়াকত আলী।
তার দাবি, এসব দলিল লেখকদের ‘সমিতির মাধ্যমে রেজিস্ট্রি অফিসে দুর্নীতি করে থাকে।’
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক (সদর) নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা চাই এখানে স্থায়ীভাবে একজন সাব রেজিস্ট্রার কর্মরত থেকে সপ্তাহের পাঁচদিনই কাজ করুন।
“তাতে ভিড় ও ভোগান্তি দুটোই কমবে। আমাদের রোজগারও ভালো হবে।”