চলতি মৌসুমে কুষ্টিয়া থেকে বিশেষ বরাদ্দে আরও ৫ হাজার টন বোরো চাল কেনার অনুমতি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে এ সংক্রান্ত লিখিত নির্দেশনা না এলেও মৌখিক নির্দেশ পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তানভীর রহমান। মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বরাদ্দের এ চালের নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় এক বিএনপি নেতা।
বিএনপির ওই নেতা ২০টি মিল মালিকের কাছ থেকে ৭৫ লাখ টাকা নিয়ে তাদের নামে বরাদ্দ দিয়েছেন সব চাল। এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন বাংলাদেশ অটো অ্যান্ড হাসকিং চালকল মালিক সমিতির এক কেন্দ্রীয় নেতা। একাধিক মিল মালিকের অভিযোগ, ওই কেন্দ্রীয় নেতা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এ বিশেষ বরাদ্দ করিয়ে এনেছেন। তার নির্দেশেই কোন মিল মালিক কত টন চাল সরকারি গুদামে সরবরাহ করবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছেন বিএনপির ওই নেতা। তবে এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ জেলার অধিকাংশ মিল মালিক। তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারকে বিপদে ফেলতেই একের পর এক চক্রান্ত করছেন মালিক সমিতির মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা সরকারবিরোধী মিল মালিকরা। এর আগেও বেশ কয়েকবার বিশেষ বরাদ্দের চাল ভাগবাটোয়ারার অভিযোগ রয়েছে এসব মিল মালিকের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনেকটা গোপনে বিশেষ বরাদ্দে ৫ হাজার টন আমন চাল একাই সরবরাহ করার পাঁয়তারা করেছিল রশিদ এগ্রো ফুড। মন্ত্রণালয় থেকেও সব চাল তার নামে বরাদ্দ দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সে সময় বিষয়টি সব মিল মালিক জেনে গেলে শুরু হয় হইচই। ঝামেলা এড়াতে মিল মালিকদের সঙ্গে সমঝোতায় বসেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। সমঝোতা বৈঠকে ৫ হাজার টনের মধ্যে রশিদ এগ্রো ফুডকে ২ হাজার ৫০০ টন এবং বাকি ২ হাজার ৫০০ টন চাল কয়েকজন প্রভাবশালী মিলারের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। এ বরাদ্দের তিন সপ্তাহ পর নতুন করে বিশেষ বরাদ্দে আরও ১০ হাজার টন আমন চাল ক্রয়ের অনুমতি দেয় মন্ত্রণালয়। এ বরাদ্দ থেকেও অধিকাংশ চাল সরবরাহ করে রশিদ এগ্রো ফুড।
গত বছর হঠাৎ করে সারা দেশে চালের দাম কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা বেড়ে যায়। অভিযোগ ছিল এ দাম বাড়ার পেছনেও রশিদ এগ্রো ফুডের কারসাজি রয়েছে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে সে সময় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রশিদ এগ্রো ফুডের গুদামে অভিযান চালিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কয়েক দিন আগে কুষ্টিয়া থেকে আবারও বিশেষ বরাদ্দে ৫ হাজার টন বোরো চাল কেনার অনুমতি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। মিল মালিকদের অভিযোগ, এবারও বিশেষ বরাদ্দের সব চাল আগেই ভাগবাটোয়ারা করেছেন চালকল মালিক সমিতির দু’জন নেতা। চালকল মালিক সমিতির ওই কেন্দ্রীয় নেতার নির্দেশে প্রভাবশালীরা ছাড়া সাধারণ মিল মালিকরা এসব চালের বরাদ্দ পাচ্ছেন না।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তানভীর রহমান জানান, মন্ত্রণালয় থেকে মৌখিকভাবে জানিয়েছে ৫ হাজার টন বোরো চাল সংগ্রহের বিশেষ বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র এখনও আসেনি। তিনি বলেন, নিয়মিত বরাদ্দ এলে সব মিল মালিকদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। তবে বিশেষ বরাদ্দের ক্ষেত্রে আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে। এবার কিভাবে বরাদ্দ দেয়া হবে- এ ব্যাপারে ডিসি স্যারের কাছ থেকেও কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা আসেনি।
জিল্লুর রহমান রাইস মিলের মালিক জিল্লুর রহমান জানান, আমাদের মতো সাধারণ মিলারদের কেউ খোঁজখবর রাখে না। আমরা কমিটির বাইরে, আমাদের কিছুই জানানো হচ্ছে না। আমি নিজেই চালকল মালিক সমিতির নেতাদের কাছে গিয়েছিলাম, তারা আমাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন এ বরাদ্দ থেকে আপনাকে মাল দেয়া সম্ভব হবে না। আগামীতে বরাদ্দ এলে আপনাকে দেয়া হবে। আমি মনের দুঃখে ওখান থেকে চলে এসেছি। তিনি বলেন, আমি কাউকে টাকা নিতেও দেখেনি, কাউকে টাকা দিতেও দেখেনি। যারা টাকা দিয়েছে তাদের কাছ থেকে শুনেছি কেজিতে দেড় টাকা করে দিয়ে তারা চাল বরাদ্দ নিয়েছেন। তবে ওই চাল যারা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন তারা সবাই কমিটির নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মিল মালিক বলেন, কেজিতে ৫০ পয়সা করে ৫ হাজার টনে ২৫ লাখ টাকা মন্ত্রণালয়ে দিয়ে এ বিশেষ বরাদ্দ করিয়েছেন কুষ্টিয়ার সবচেয়ে বড় মিল রশিদ এগ্রো ফুডের মালিক ও বাংলাদেশ অটো অ্যান্ড হাসকিং চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ। ওই নেতার নির্দেশে মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ বরাদ্দের এ চালের নিয়ন্ত্রণ করছেন কুষ্টিয়া সদর থানা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান ও কোষাধ্যক্ষ লিয়াকত আলী। সম্প্রতি খাজানগরের একটি অটো রাইস মিলে বসে চাল ভাগবাটোয়ারা করেন এই দুই নেতা। চালকল মালিক সমিতির বিভিন্ন পদে থাকা জেলার প্রভাবশালী ২০ মিলারের নামে ভাগ করে দেয়া হয়েছে ৫ হাজার টন চালের বরাদ্দ। এ সময় উপস্থিত এক মিল মালিক বলেন, বিশেষ বরাদ্দের চালে কেজিতে দেড় টাকা দিতে হয়েছে। যারা টাকা দিয়েছেন শুধু তারাই এ চালের বরাদ্দ পেয়েছেন। বরাদ্দের ক্ষেত্রে বেছে নেয়া হয়েছে প্রভাবশালী মিল মালিকদের, যাতে কেউ ঝামেলা করতে না পারে। মিল মালিকরা কেজিতে দেড় টাকা করে জয়নাল আবেদিন ও লিয়াকত আলীর কাছে ৫ হাজার টন চালে ৭৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে এ টাকা তুলেছেন জয়নাল আবেদিন।
চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বলেন, এখনও বিশেষ বরাদ্দ আসেনি। বরাদ্দ এলে বিপদের সময় যারা গুদামে চাল দিয়েছেন তারাই পাবেন। তিনি বলেন, টাকা নেয়ার এসব অভিযোগ সত্য নয়। সংগঠনের জন্য আমরা মিলারদের কাছ থেকে টাকা নিলেও সেটা সংগঠনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে একই মন্তব্য করেছেন চালকল মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ লিয়াকত আলী। জনকল্যাণ রাইস মিলের মালিক মোতালেব হোসেন বলেন, আমরা সাধারণ গরিব মিলার। এদের সঙ্গে যুদ্ধ করা সম্ভব না। কী হচ্ছে সবাই জানে। আপনারা অফিসারদের কাছ থেকেই সব জানতে পারবেন।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে নিয়মিত বরাদ্দে কুষ্টিয়া থেকে ১৫ হাজার টন বোরো চাল কেনার অনুমতি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। জেলার তালিকাভুক্ত ৭শ’ মিল মালিকের কাছ থেকে চাল ক্রয় শুরু করেছে খাদ্য বিভাগ। মে মাস থেকে শুরু হওয়া চাল সংগ্রহ অব্যাহত থাকবে আগস্ট মাস পর্যন্ত। ইতিমধ্যে ১৩ হাজার টন চাল ক্রয় শেষ হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
সূত্র: যূগান্তর