কুষ্টিয়ায় বোরো ধান কাটা নিয়ে বিপাকে চাষিরা।‘ধানের যে দাম, এক মণ ধান বিক্রি করে একটা লেবার খরচও হচ্ছে না। সাড়ে ৫০০ টাকা মণ ধান আর ৬০০-৭০০ টাকা একটা ধান কাটা লেবার। তাও হাতে পায়ে ধরে আনতে হচ্ছে তাদের। কি করা ধান যেহেতু চাষ করেছি, কাটতে তো হবেই। খাওয়ার জন্য তৈরি করেছি, না কাটলেওতো হয় না।’ ধান কেটে আনার সময় এমনটাই বলছিলেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা ইউনিয়নের কৃষক বদর উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘ধানের দাম প্রতিবছরই বাড়ে, এবারও বাড়তে পারে তবে যখন আমার মতো কৃষকের ঘরে ধান থাকবে না তখন। সরকারের কাছ থেকে আজীবন লাভ করে মিল মালিকরা আর ব্যবসায়ীরা। আর আমরা কৃষক আজীবন কাজ করেই মরবো। আমাদের কেনার সময় সারের দাম বেশি, বীজের দাম বেশি, কিটনাশকের দাম বেশি, শুধু বিক্রির সময় ধানের দাম কম। চাউলের দাম বাড়ে আর ধানের দাম কমে। আমরা ধান লাগিয়ে পড়েছি মহা বিপদে। এক মণ ধান বিক্রি করে যদি একটা লেবারের হাজিরা না হয়, এ কথা বলবো কার কাছে। ’
এ এলাকার আরেক কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, চাষিদের পদে পদে বিপদ। সার, বীজ, কিটনাশক সব কিছুরই দাম চড়া। এমনকি ধানের চাউলেরও দাম বেশি, সে তুলনায় ধানের নুন্যতম ন্যায্যমূল্য টুকুও নেই। প্রতিবিঘা ধান উৎপাদন করতে যে খরচ হয়, বর্তমানে ধান বিক্রি করে তার লেবার খরচই উঠছে না।
তিনি আরো বলেন, শুধু মাত্র ধান কাটার জন্য বিঘাপ্রতি ৫ জন শ্রমিক প্রয়োজন। বর্তমানে ধান কাটা শ্রমিকের সংকট হওয়ায় শ্রমিকের মজুরি বেশি। ৬০০-৭০০ টাকার কমে কেউ ধান কাটতে আসছে না। এদিকে এক মণ ধান বিক্রি করলে আমরা সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন ধান প্রতিমন ন্যূনতম ১ হাজার টাকা হলে চাষিদের আসল বাঁচবে। বর্তমানে উপায় না পেয়ে লস দিয়ে ধানের আবাদ করছি আমরা।
কৃষক খাইরুল মালিথা জানান, ধানের চাইতে এখন ধানের কুড়া, খুদের দামই তুলনামূলকভাবে বেশি। ১৪-১৫ টাকা কেজি ধান বিক্রি করছি আর সেখানে ধানের কুঁড়া ১০-১২ টাকা কেজি এবং খুদ ২০-২২ টাকা কেজি। এক কেজি ধান ১৪-১৫ টাকা দাম বাজারে। এক কেজি ধান উৎপাদন করতেই তার চেয়ে বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, কৃষককের এখন ধান কাটার দরকার। লেবাররা বলছে ৬০০ টাকা হাজিরা দিলে যাবো না হলে যাবো না। দরকার হয় কাটো না হলে না। কৃষক বিপদে পড়ে লেবার নিতে বাধ্য হচ্ছে।
মিরপুর উপজেলার খয়েরপুর বাজার ঘুরে দেখা যায়, মোটা ধান ৫৫০ টাকা থেকে ৫৮০ টাকা, মাঝারি ৬০০ থেকে ৬২০ টাকা, এবং চিকন ধান ৬৫০ থেকে ৬৮০ টাকা।
জেলা কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩৫ হাজার ৩১৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ৯০ ভাগ জমিতে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের ধান চাষ হয়েছে। আবহাওয়া ভালো ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ না হওয়ায় ধানের ফলন খুবই ভালো হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা শেষ করেছে কৃষক। তবে ধানের দাম কম এবং শ্রমিক সংকট হওয়ায় চাষিরা একটু বিপাকে পড়েছে।
মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবীদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, এ বছর ধানের উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময় কৃষকরা শ্রমিক না পাওয়ায় অতিরিক্ত মূল্য দিতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে ধানের দামও তুলনামূলক ভাবে কম। ধানের ফলন ভালো হলেও বাজার কৃষকেরা ন্যায্যদাম পাচ্ছেন না। দাম না পেলে কষ্ট করে আাবাদ করা ধান চাষ থেকে তারা বিমুখ হবেন। বাজার মন্দার বিষয়টি খতিয়ে দেখা অতীবও প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, আমরা যদি আমাদের উৎপাদিত ধান থেকে চাউল বিদেশে রপ্তানি করতে পারি তাহলে কৃষক ভালো দাম পাবে। সেই সাথে শ্রমিক সংকটে আধুনিক ধান কাটা, মড়ায়ে যান্ত্রিক শক্তি ব্যবহারের পরামর্শ দেন এই কৃষি কর্মকর্তা।
এদিকে কৃষকদের কৌশলী হয়ে কম দামে ধান বিক্রি না করে বাড়িতে কয়েকদিন সংরক্ষণ করে বিক্রির পরামর্শ দিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রাসারণ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সুশান্ত কুমার প্রামাণিক।
জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন জানান, কৃষকের ধানের নায্যমূল্যে নিশ্চিত করতে হাটগুলোতে তদারকি বাড়ানো হবে।