গত বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে পদ্মা নদীতে ব্যাপক আকারে পানি বাড়তে শুরু করেছে। গত ১০ দিনে পানি বাড়ার সাথে সাথে শুরু হয়েছে ভাঙ্গন। পানির তোড়ে কুষ্টিয়া কুমারখালী উপজেলার গ্রাম সংলগ্ন পাড়ের জমি বিলীন হচ্ছে। প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন তীব্র হচ্ছে। ঝুঁকিতে আছে সদ্য নির্মাণ করা শিলাইদহ কুঠিবাড়ি রক্ষা বাঁধ। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে নদী তীরবর্তী কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা। এলাকার অনেকে বাঁশ দিয়ে পাইলিং করে ভাঙ্গন ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।
সরেজমিন ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পদ্মা নদীতে পানি বাড়ছে। এতে কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের কোমরকান্দী গ্রামের পদ্মা তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। কৃষি জমি ভাঙ্গছে। বেশ কিছু বাড়ি ও স্থাপনা একেবারে ঝুঁকির মধ্যে আছে। যে কোন সময় নদী গর্ভে চলে যাবে সেগুলো।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে সদ্য নির্মাণ করা বাধের দুই মুখ ঝুঁকিতে আছে। কেননা পানির তীব্র স্রোতে বাধের মুখের ভেতর দিয়ে মাটি ভেঙে যাবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া বাঁধ নির্মাণের সময় এলাকায় কয়েকজন মানুষ জমি দেয়নি। সেখানে বাঁধ পুরোপুরি শেষ করা যায়নি। সেই সব স্থানেও ভাঙ্গতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের দিকে কুঠিবাড়ি সংলগ্ন পদ্মা নদী ভেঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ির দিকে আসতে শুরু করে। এরপর থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কুঠিবাড়িসহ কয়া ও শিলাইদহ ইউনিয়নের গ্রাম রক্ষায় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করে। ২০১৬ সালের ১৩ আগষ্ট বাংলাদেশ ডিজেল প¬ান্ট (বিডিপি) লিমিটেড নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এর কার্যাদেশ পান। ব্যয় ধরা হয় ১৬৭ কোটি টাকা। তবে মূল ঠিকাদারের সহযোগি প্রতিষ্ঠান ওয়েষ্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড বাঁধের কাজ করে। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর কাজ শুরু করে সংশি¬ষ্ট প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরের ৩১ জুন কাজ শেষ করে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান,‘ কয়া ইউনিয়নের সুলতানপুর থেকে শুরু করে শিলাইদহ খেয়াঘাট পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৫ হাজার ২২০ মিটার। এরমধ্যে কয়া ইউনিয়নের সুলতানপুর, শ্রীকোল, কোমরকান্দী ও শিলাইদহ গ্রাম পড়েছে। সুলতানপুর থেকে শ্রীকোল পর্যন্ত ২ হাজার ৭২০ মিটার ও কোমরকান্দী পূর্বপাড়া থেকে শিলাইদহ খেয়াঘাট পর্যন্ত এক হাজার মিটার বাধের কাজ হয়। এতে ব্যয় হয় ১৪৫ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদের মধ্যে কাজ করতে না পারায় ২২ কোটি টাকা ফেরত যায়। কিন্তু সে সময় বাঁধের নকশায় কোমরকান্দী পশ্চিমপাড়া থেকে পূর্বপাড়া পর্যন্ত ১ হাজার ৫৩০ মিটার এলাকা রাখা ছিল না। এখন বন্যা দেখা দেওয়ায় এ এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। কুঠিবাড়ি রক্ষা প্রকল্পের যে বাঁধ রয়েছে তার একটি অংশের সামনের দিকে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। সেখানে ব¬ক বসানোর জন্য যে মাটি তোলা হয়েছে, তার বেশির ভাগ বিলিন হয়ে গেছে। পানি বাড়লে এ অংশের বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। কোমরকান্দী পশ্চিমপাড়া থেকে পূর্বপাড়া পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে আবাদী জমি ভেঙে গ্রামের বসতবাড়ির কাছে ভাঙন ছুইছুই করছে। বেশ কয়েক জায়গায় বাঁশবাগান নদীতে তলিয়ে গেছে। বটগাছ পানির ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ বাঁশ দিয়ে পাড় ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। পূর্ব ও পশ্চিম দুই প্রান্তে বাঁধের মুখের মাটি সরে গেছে। সেখানে বাধ ঝুঁকিতে রয়েছে।
কোমরকান্দী পূর্বপাড়া এলাকার বাসিন্দা মজিবর রহমান বলেন,‘বাঁধের মাথায় আমার বাড়ি। খুব ভয়াবহ অবস্থা। ভাঙনে অসুবিধা হচ্ছে। ভিটা ছাড়া কোন জমি নেই। পানি প্রায় বাড়ি ধরধর।
আবদুল বারী বলেন, ঢেউয়ে পানি সরে যাচ্ছে। সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছে। বাঁধ নির্মাণ বাদ রাখায় এ অংশ এবার ভেঙ্গে যাবার মত অবস্থা হয়েছে। সরকারের কাছে দাবি যেন দ্রুত বাঁধ নির্মাণ করে দেয়। শিলাইদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন খান তারেক বলেন, কোমরকান্দী এলাকার বাসিন্দারা চরম ঝুঁকিতে আছে। বাধের অংশও বিপদমুক্ত না। এই এলাকাটা দ্রুত কোন পদক্ষেপ না দেওয়া হলে স্কুলসহ গ্রামের কয়েক শ’ বাসিন্দার বাড়িঘর বিলীন হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে এক শ’ ফুট এলাকা ভেঙে গ্রামের দিকে নদী চলে এসেছে।
পাউবোর এক কর্মকর্তা মনে করেন, যে ২২ কোটি টাকা ফেরত গেছে সেটার সাথে আরও কিছু টাকা দিয়ে কোমরকান্দী এলাকায় বাধ নির্মাণ করা গেলে এ বিপদ এড়ানো সম্ভব হতো। এখনতো সদ্য নির্মিত বাঁধও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।
ওয়েষ্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেডের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি রক্ষা বাঁধ প্রকল্পের সমন্বয়ক মোফাজ্জেল হক বলেন, যে অংশে বাঁধ নেই সেখানে ভাঙনের ফলে বাধের সমস্যা হতে পারে। এজন্য ওই অংশটুকুও বাধ নির্মাণ করা প্রয়োজন। বাঁধের যেকোন সমস্যা মোকাবেলায় আপদকালীন মেরামতের জন্য দুই লাখ বড় ব¬ক মুজদ রাখা আছে।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফউজ্জামান খান বলেন, এই মূহুর্তে কোন প্রকল্প নেই। যে অংশ বাধ নেই সেখানে ভাঙছে। মানুষের কিছু জমি বিলীন হয়ে গেছে। বঁধে কোন সমস্যা হলে আগামী এক বছর ঠিকাদার ব¬ক ফেলে ঠিক করে দিবে। তবে দেড় কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা গেলে আপাতত গ্রামসহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি রক্ষা বাঁধ পুরোপুরি ঝুঁকি মুক্ত থাকতো।