তহবিল শুন্য করে ১৮ লাখ টাকা নিয়ে নিজের জায়গা ভরাট করেছেন সাবেক সভাপতি জন। অর্ধকোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহে অবস্থিত পোড়াদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ফান্ডের প্রায় অর্ধকোটি টাকারও বেশি নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। ভাইকে প্রধান শিক্ষক বানিয়ে তার সাথে যোগসাজসে এসব অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে পোড়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সদ্য বাদ যাওয়া স্কুল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ফারুকুজ্জামান জন।
গত ৫ বছরে স্কুল ফান্ডের টাকা দিয়ে সভাপতি তার নিজের জায়গা ভরাটসহ বিভিন্ন প্রকল্পের আড়ালে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে এক তদন্তে উঠে এসেছে এ অভিযোগ। প্রধান শিক্ষক নিজেও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে এলাকাজুড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ফেব্র“য়ারি মাস থেকে থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ফারুকুজ্জামান জন। সভাপতি হওয়ার পর নিজের আপন চাচাতো ভাইকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর শুরু হয় ফান্ডে থাকা কোটি টাকা আত্মসাতের পরিকল্পনা।
গত ৫ বছরে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এসব টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। যার মধ্যে স্কুল ফান্ড থেকে ১৮ লাখ টাকা নিয়ে সভাপতি তার নিজের জায়গা ভরাট করেছেন। বিষয়টি তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করে একটি প্রত্যায়ন দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক। সভাপতির পদ যাওয়ার আগ মূহুর্তে তহবিল থেকে টাকা নেয়ায় এখন শূন্য হয়ে পড়েছে তহবিল।
বিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে, ফারুকুজ্জামান জন সভাপতি হওয়ার পর ইচ্ছামত বিদ্যালয় তহবিলের লাখ লাখ টাকা অনিয়ম করেছেন। ভাউচার ছাড়াই অর্থ খরচ করেছে। এছাড়া নিয়োগ, সরকারি অনুদান ও দোকান নির্মাণের অর্থ তহবিলে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। স্কুলকে একেবারে ফোকলা করে গেছেন। বিদ্যালয়েরতো কোন উন্নয়ন হয়নি বরং পকেট ভরছেন প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি।
জন বাদ যাওয়ার পর স্কুলের নতুন সভাপতি হিসেবে নিয়োগ পান আইনজীবী আমিনুজ্জামান রাজু। রাজু পোড়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যানের আনোয়ারুজ্জামান বিশ্বাস মজনুর ছোট ভাই। সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি জানার পর তিনি একটি তদন্ত টিম গঠন করেন।
স্কুলের তিনজন শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদের দুই সদস্যকে দিয়ে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। চলতি বছরের ২২ জুলাই কমিটি তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দিয়েছে।
প্রতিবেদনে ২৭টি খাতে অর্থ খরচ ও উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় বড় অনিয়ম রয়েছে।
২০১৪ সালে বিদ্যালয়ের পুর্ব-পশ্চিম পাশে দোকান ঘর নির্মাণ করা হয়। শ্রেনী কক্ষকে পাটিশন আর শাটার দিয়ে মোট ২২টি দোকান নির্মাণ করে সাবেক সভাপতি জন। নির্মাণ খরচ বাবদ ফান্ড থেকে তুলে নেন ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। দোকান ঘর বরাদ্দ বাবদ ১০ লাখ ৯৫ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা তহবিলে জমা দিয়ে বাকি ৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা জন পকেটে ঢুকায়।
স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষককে দোকান ঘর বাবদ ৫০ হাজার দিয়ে খরচ দেখনো হয় ১ লাখ টাকা। এছাড়া পাশেই কাটদাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে স্কুলের সম্পত্তি পানির দরে বিক্রি করে দেন। সেই ৪ লক্ষ টাকাও পকেটে পোরেন জন।
সরকার থেকে বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য ৪০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য দেয়া হয় । ৪০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বিক্রির ৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা ফান্ডে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এছাড়া সিসি ক্যামেরা লাগানো বাবদ সাড়ে ৩ লাখ টাকা বিল উত্তোলন করা হলেও সেখানেও হয়েছে অনিময়। নিন্মমানের কয়েকটি সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে বিল তুলে নেয়া হয়েছে।
এছাড়া স্থাণীয় খোকন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে দোকান ঘর বরাদ্দ বাবদ ৬ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা জামানত নিলেও তার অর্ধেক তহবিলে জমা হয়েছে। বিদ্যালয়ের পাশে ফাঁকা জায়গায় দোকান ঘর নির্মাণ না করে জামানত বাবদ নেন ৮ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। সেই টাকাও নয়ছয় করেছেন।
শুধু ফান্ডের নগদ অর্থ নয় অনুমতি না নিয়েই বিদ্যালয়ের ৬টি কাঁঠাল গাছসহ ১২টি গাছ কেটে বিক্রি করে দেয়। বিদ্যালয়ের ৮ শতক জায়গায় বালি ভরাটের নামে ১৯ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা তুলে নিয়ে পকেটে ভরেছেন জন। এছাড়া প্রাচীর নির্মাণের নামে ২ লক্ষ টাকা, ৭টি দোকান ঘর নির্মাণের আয় ও ব্যয় দেখানো হয়নি।
প্রধান শিক্ষকের দেয়া প্রত্যায়ন থেকে জানা গেছে, স্কুলের পাশেই জনের ১৫ শতক জমি ছিল। সেই জমিতে গর্ত থাকায় তা ভরাট করার জন্য ফান্ড থেকে জোরপুর্বক ১৮ লাখ ২০ হাজার তুলে নেন। সভাপতি তার নিজের জায়গা বিদ্যালয়ের অর্থ দিয়ে ভরাট করে নেন। এ কারনে বিদ্যালয়ের ফান্ড শূন্য বলে প্রত্যায়নে উলে¬খ করেছেন।
তদন্তকারি একজন শিক্ষক বলেন, আয় ব্যায়ের কোন সঠিক ভাউচার নেই। শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে ২২ লাখ টাকা স্কুল উন্নয়নের জন্য নেয়া হয়েছিল। তার এক টাকাও ফান্ডে জমা হয়নি। একই ভাবে ভাউচার ছাড়ায় লাখ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। নির্বাচেন মনোনয়ন বিক্রি হয়েছিল সেই টাকারও কোন হদিস নেই।
তদন্ত কমিটির সদস্য বিদ্যুৎসাহী সদস্য জহুরুল ইসলাম বলেন, ৫ বছরে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। এমনকি ফান্ডের টাকা নিয়ে নিজের জায়গা ভরাট করেছেন সাবেক সভাপতি। ১৮ লাখ টাকা তিনি জোরপুর্বক নিয়ে গেছেন। এতে স্কুল তহবিল শূন্য।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক আসলাম আলী সাবেক সভাপতি ফারুকুজ্জামান জনের সম্পর্কে চাচাতো ভাই। ভাইকে স্কুলে নিয়োগ দিয়ে তার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন।’
প্রধান শিক্ষক আসলাম আলীর সাথে কথা বলতে তার মোবাইলে রিং দিলে সব অভিযোগ শুনে বলেন, আমি ব্যস্ত আছি পরে কথা বলব। পরে আবার রিং দিলে তিনি নানা অজুহাতে কথা বলতে রাজী হননি।’
পোড়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আনোয়ারুজ্জামান বিশ্বাস মজনু বলেন,‘ জন সভাপতি থাকতে লাখ লাখ টাকা অনিয়ম হয়েছে। তদন্তে বিষয়টি উঠে এসেছে। স্কুল ফান্ডকে সে একেবারে শেষ করে দিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে অর্ধকোটির বেশি টাকা নয়ছয় হয়েছে। এ বিষয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করছি।’
স্কুলের বর্তমান সভাপতি নিযুক্ত হয়েছে আনোয়ারুজ্জামান বিশ্বাস মজনুর ছোট ভাই অ্যাডভোকেট আমিনুজ্জামান বিশ্বাস রাজু। কথা বলে রাজু বলেন, তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর দেখতে পান ফান্ডে কোন অর্থ নেই। এছাড়া অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। তাই ৫ সদস্যের একটি তদন্ত টিম করা হয়েছিল। তারা প্রতিবেদন দিয়েছে।
সেই প্রতিবেদনে অনেক অনিয়ম ও অর্থ নয়ছয়ের বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রধান শিক্ষক নিজেও বিষয়গুলো স্বীকার করেছেন। সবার মতমত নিয়ে পরবর্তি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
নানা অভিযোগের বিষয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি ফারুকুজ্জামান জন বলেন, বিধি অনুযায়ী সব অর্থ খরচ করা হয়েছে। কোন অনিয়ম হয়নি। একটি পক্ষ আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে।’
উলে¬খ, ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে সম্প্রতি উপজেলা নির্বাচন করেন ফারুকুজ্জামান জন।