মহামারী করোনার কারনে সাধারণ মানুষ যখন প্রায় ঘরবন্দী অবস্থায় রয়েছে তখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সীমান্তের মাদক ব্যবসায়ীরা। সীমান্ত অঘোষিত দখল নিয়ে জমজমাট মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তবে মাঝে মধ্যে পুলিশ, র্যাব ও সীমান্তরক্ষী বিজিবি’র অভিযানে মাদকসহ মাদক পাচারকারী ও ব্যবসায়ী ধরা পড়লেও মাদক পাচারের তুলনায় তা নগন্য বলে সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামবাসীদের অভিমত।
দৌলতপুরে ৪৬ কি. মি. জুড়ে সীমান্ত রয়েছে। যার প্রায় অর্ধেক ভারত সীমান্তে তারকাটার বেড়া বেষ্টিত। অর্থাৎ ধর্মদহ সীমান্তের ওপার ভারতের ফুলবাড়ি-শিকারপুর সীমান্ত থেকে মুন্সিগঞ্জের ওপার নাসিরাবাদ সীমান্ত পর্যন্ত। এরমধ্যে বাংলাদেশ সীমানায় রয়েছে আদাবাড়িয়া, প্রাগপুর, রামকৃষ্ণপুর ও চিলমারী ইউনিয়ন। ৪টি ইউনিয়নের বিপরীতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয় জেলার মরুটিয়া থানা, করিমপুর থানা, হোগলবাড়িয়া থানা ও মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গী থানা। তবে মাদক পাচারের রুট হিসেবে বিলগাথুয়া, মহিষকুন্ডিমাঠপাড়া, জামালপুর, ঠোটারপাড়া, মুন্সিগঞ্জ, চরপাড়া, চল্লিশপাড়া, ছলিমেরচর, চিলমারী, চরচিলমারী, বাংলাবাজার, মানিকেরচর, উদয়নগরসহ অনন্ত ২০টিরও বেশী সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মাদকপাচারকারী সুযোগ বুঝে মাদক পাচার করে থাকে। এরমধ্যে রামকৃষ্ণপুর ও চিলমারী ইউনিয়নের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে মাদক পাচারকারীরা নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করে। কারন দুই ইউনিয়নের বিপরীতে ভারত সীমানায় তারকাটার বেড়া না থাকায় মাদক পাচারকারীরা অনেকটা নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলকা ঘুরে ও সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানাগেছে, করোনার কারনে মানুষ যখন নিজেদেরকে নিরাপদ রাখতে ও করোনামুক্ত থাকতে সামাজিক ও শরীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করছে তখন এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি নতুন করে উঠতি বয়সী ছেলেরা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন রাতের আধাঁরে সংগবদ্ধ সশস্ত্র মাদক পাচারকারীচক্র অবাঁধে মাদক পাচার করে থাকে। আর পাচার হওয়া মাদকের তালিকায় রয়েছে গাঁজা, ফেনসিডিল ও ইয়াবা। মাদক পাচারের সাথে অস্ত্র পাচারও হয়ে থাকে। তবে মাদক পাচারের তুলনায় তা কম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুন্সিগঞ্জ ও ভাগজোত এলাকার লোকজন জানান, রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার যারা মাদক ব্যবসা ও মাদক পাচারের সাথে জড়িত রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে হারেজ, রেজাউল, রফিকুল, আশরাফুল, ফিরোজ, মিন্টু, ছালাম, কালাম, বাদেশ, হাবুল, শামীম, সালাম, কুদরত, মহি, বাবু বাঙ্গাল, বশির, রাজিবুল, বাদশা, সান্টু, হেলাল, মালুদ, বাবু, মিজান, হাবু, শাহাজামাল, মেহেদী, সরিসহ ৩৫ থেকে ৪০ জন ছোট বড় মাদক ব্যবসায়ী ও পাচারকারী। তবে এসব মাদক পাচারকারী ও ব্যবসায়ীদের অনেকের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও গডফাদার হিসেবে পরিচিত যারা সব সময়ই থাকেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মাদক পাচার করার সময় কেউ ধরা পড়লে তাদের ছাড়ানোর জন্য দেন দরবার থেকে শুরু করে জেলহাজত থেকে জামিনে মুক্ত করা পর্যন্ত কাজটি করে থাকে ওইসব নেপথ্য শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও গডফাদাররা। মজার ব্যাপার হলো পুলিশ বা বিজিবি’র হাতে কোন মাদক পাচারকারী ধরা পড়লে জিজ্ঞাসাবাদে গডফাদারদের নাম তারা মুখে আনতে চাই না। আবার মাদক পাচারের কাজে নারী মাদক পাচারকারীরাও রয়েছে। তারাও বিভিন্ন কৌশলে মাদক পাচার করে থাকে। বিনিময়ে পেয়ে থাকে মোটা অংকের টাকা।
মাদক পাচার রোধে পুলিশ ও বিজিবি শক্ত অবস্থানে থাকলেও বিপরীতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ততটায় রয়েছে নরম অবস্থানে। মুলত: তাদের ছত্রছায়ায় ভারতীয় মাদক পাচারকারী ও মাদক ব্যবসায়ীরা রাতের আঁধারে তারকাটার বেড়া পার করে বাংলাদেশ সীমানায় মাদক পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে থাকে। একসময় ভারতীয় ফেনসিডিল কাঁচের বোতলে করে পাচার করা হতো। তারকাটার বেড়ার ওপার থেকে বাংলাদেশ সীমানায় ছুড়ে ফেলা হলে তা ভেঙ্গে যাওয়ার কারনে পরবর্তীতে প্লাষ্টিকের বোতলে প্যাকেটজাত করে পাচার করা হয়। আর ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা এসব মাদক হাত বদল হয়ে রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ওইসব মাদক পাচারকারীসহ দৌলতপুর সীমান্তের বিভিন্ন মাদক পাচারকারী ও ব্যবসায়ীরা দৌলতপুর থেকে দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে। এরফলে রাতারাতি তাদের নাম উঠে যাচ্ছে ধনীদের তালিকায়। গড়ে তুলছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সুরম্য অট্টলিকা ও প্রসাদ। আর এমন সব প্রাসাদ ভাগজোত বাজার ঘুরলে চোখে পড়বে।
রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের উল্লেখিত মাদক ব্যবসায়ীদের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজ মন্ডল সত্যতা স্বীকার করে বলেন, করোনার এই দুঃসময়ে মানুষ নিজেদের বাঁচাবে কিভাবে তা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও মাদক পাচারকারী ও ব্যবসায়ীরা রয়েছে বহাল তবিয়তে। রাতের আধাঁরে তারা অবাঁধে মাদক পাচার করে থাকে। সশস্ত্র সংগবদ্ধ থাকার কারনে ভয়ে তাদের কিছু বলাও যায়না। মাদক ব্যবসার অবৈধ আয়ের কোটি কোটি টাকা খরচ করে বড় বড় বিল্ডিং বাড়ি বানাচ্ছে, যা সবার জানা। প্রশাসনের অনেকে মাদক পাচার ও ব্যবসা করানোর কাজে জড়িত রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সীমান্তের মাদক ব্যবসায়ী ও পাচারকারীদের প্রশাসন থেকে শুরু করে সব ধরণের সহায়তা দিয়ে থাকেন সীমান্তের এক বড়ভাই। তাকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে মাদক ব্যবসার তালিকায় নাম লেখাতেও হবে আবার মাদক পাচার ও ব্যবসাও করতে হবে। এর ব্যতয় ঘটলে পরক্ষনেই পুলিশ গিয়ে হাজির হবে ওই মাদক পাচারকারী ও ব্যবসায়ীর বাড়িতে। আর এমন কাজ তিনি করে যাচ্ছেন যুগ যুগ ধরে। প্রশাসনের দপ্তরেও রয়েছে তার অবাঁধ যাতায়াত। তাকে ভয় ও সমীহ না করলেই সীমান্তবাসীর কপালে জুটে পুলিশে লাঠি। আর এমন ঘটনা সবারই জানা।
মাদক ব্যবসা ও মাদক পাচারের বিষয়ে দৌলতপুর থানার ওসি এস এম আরিফুর রহমান বলেন, প্রতিদিনই মাদক বিরোধী অভিযান চলছে। মাদকসহ মাদক পাচারকারী ও মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তারও হচ্ছে এবং মামলাও হচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ী যেই হোক না কেন তাকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নাই। মাদকের বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স রয়েছি।
করোনা করুনা করলেও মাদকের ভয়াল থাবা কাউকে করুনা করবে না। তাই মাদক প্রতিরোধে প্রয়োজন সকলের সহযোগিতা ও সচেতনতা।