“আল্লারদর্গা” কথাটি শুনলেই অনেকের ধারনা নিশ্চয় এখানে একটি মাজার বা দরগা আছে। প্রকৃত পক্ষে এখানে তেমন কিছুই নেই, আছে শুধু একটি মসজিদ, তবে নাম করণের ইতিহাসের পিছনে রয়েছে চমকপদ সত্য ঘটনা।
আল্লারদর্গা তৎকালিন নদীয়া জেলার তথা বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের হলুদবাড়ীয়া গ্রামের একটি বাজার মসজিদের নাম। এই স্থানটি ঘোলদহ তথা বর্তমান হিসনা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত ছোট্ট একটি বাজারের নাম ও মসজিদের কেন্দ্র বিন্দু থেকে উৎপত্তি স্থল যা আল্লারদর্গা নামে পরিচিত, স্থানটি ম্যাচ,সিগারেট,বিড়ি,চাউল,চটের বস্তা,জর্দ্দা,মশার কয়েলসহ নানা শিল্প নগরীতে পরিণত হয়েছে।
“আল্লারদর্গা” নামের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে লোক মূখে জানাগেছে, এখন থেকে প্রায় আড়াই ‘শ’ বছর আগে বৃটিশ শাসনামলে ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে একটি পরিবার বর্তমান দৌলতপুর উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের মিরপুর গ্রামে কয়েকটি তালুক নিয়ে বসবাস করতে থাকে। পরিবারটির কর্তা ছিলেন ছুটি মন্ডল, তার ৫ সন্তান মিলন, আলম,চাঁদ,সুবাদ ও ফাতাব। ছুটি মন্ডলের ৫ সন্তানের মধ্যে আলম ছিলেন খোদা ভীরু,নামাজী ও আধ্যাতিক জগতের মানুষ, ঘোলদহ নদীর তীরে বর্তমান মসজিদ স্থলে নিরিবিলি পরিবেশে একটি উপাশনালয় গড়ে তুলে ছিলেন এবং নিজের অর্জিত সম্পদ মানুষের কল্যাণে ব্যায় করতেন।
হিসনা তথা ঘোলদহ নদী তখন পূর্ণ যৌবনা, অপরূপ রূপ ছিল এই নদীটির, প্রমক্তা পদ্মার শাখা নদী হওয়ার কারণে ছিল স্রত্বোম্বীনি, নদীর পানি সব সময় ঘোলা হয়ে থাকতো বলে মানুষ ঘোলদহ নাম করণ করে ছিল বলে ধারণা করা হয়, পরে ১৯৮৫ সালে তৎকালিন প্রধান মন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ঘোলদহ পাল্টে নদীর নাম করণ করেন “হিসনা”। মানুষসহ মালামাল পরিবহনের একমাত্র নৌপথ ঘোলদহ হয়ে পদ্মা-যমুনা নদীপথ হিসেবে যথেষ্ট কদর ছিল, ঘোলদহ হয়ে পদ্মা-হয়ে ঢাকা-চাঁদপুর যাওয়ার সহজ নৌপথ ছিল ব্যবসায়ীদের, বড় বড় জাহাজ চলাচল করতো, প্রকৃতিক অপরূপ রূপ সোন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইংরেজরা ১৭৬৮ সলের দিকে “নীলকুঠি” গড়ে তুলে ছিল পদ্মা-ঘোলদহের ব-দ্বীপে, সেটি বর্তমান সোনাই কুন্ডি কুঠি বাজার। এখন কুঠি বাড়ীাট ভূমি অফিস ও স্থানটি ডিসি পার্ক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
ঘোলদহ নদীর তীরে বসবাস রত আলম ফকিরের গুন ও যশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মানুষ তাঁর কাছে ভীড় জমাতে থাকে, কয়েক বছরের মধ্যে উপাশনালয়ের আশে পাশে দোকান-পাট সহ জন বসতি বাড়তে থাকে, স্থানটি আলমের দর্গা বলেই বিশেষ ভাবে পরিচিতি লাভ করে। খোদা ভীরু আলম ফকির নাম করণের বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন, এ পৃথিবীতে আমার বলে কিছু নেই, দৃশ্যে অদৃশ্যে যা কিছু মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর। বিষয়টি নিয়ে এলাকার মানুষকে তিনি ডেকে বুঝিয়ে বললেন, “আলমের দর্গা” কথাটি বাদ দিয়ে তোমরা এ স্থানটির নাম “আল্লারদর্গা” বলে পরিচয় দিবে। বর্তমান হিসনা নদীর তীরে বিশাল জন বসতি ও শিল্প নগরী খ্যাত স্থানটি এখনো আলম ফকিরের রাখা নাম “আল্লারদর্গা” হিসেবে নাম করণ করা হয়েছে।
আল্লাহ ভক্ত আধ্যাতিক জ্ঞানের অধিকারী আলম ফকির তাঁর জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর অলৌকিক ক্ষমতার বহু নিদর্শণ রেখে গেছেন, যার নামের গুনে মানুষ যুগযুগ ধরে উপক্রিত হয়েছে বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। এখনো তাঁর আশ্রম স্থানে যে বিশাল মসজিদ গড়ে উঠেছে, এই মসজিদে বিভিন্ন নিয়াতে আল্লার ওয়াস্তে দান করে, চাওয়া-পাওয়া বিষয়ে কেহ নিরাশ হয়নি।
আলম ফকিরের জীবনী বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে অনেক ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনা, এলাকায় খুনের একটি মামলায় স্বাক্ষী দিতে গিয়ে ছিলেন আলম ফকির তৎকালীন ভারতের কৃষ্ণনগর কোর্টে, বিচারকের কাছে বলে ছিলেন দুপুরের আগে তাঁর স্বাক্ষী নিয়ে নিতে, করণ দুপুরের পর সে এ পৃথিবীতে থাকবে না। কৌতুহল বসত বিচারক ফকিরের কথা যাচাই করার জন্য তাঁর স্বাক্ষী নিতে পারলেও নেওয়া হয়নি,দুপুর পর ফকির কোর্টের বারান্দায় সত্য সত্যই প্রাণ ত্যাগ করেন।
ফকিরের লাশ নিয়ে আর এক ঘটনার সূচনা হয়, এলাকাবাসী জানাই গরুর গাড়ীতে করে লাশ গাংনি থানার হাড়া ভাঙ্গা গ্রামে আসলে গাড়ী আর সামনের দিকে গড়ে না, জোর করে সামনে গড়ানোর চেষ্টা করলে লাশ থেকে কঠিন পঁচা দূগন্ধ বের হতে থাকে, পিছনের দিকে আসলে সু-মিষ্ট গন্ধ বের হতে থাকে। ঐ সময় আত্বীয় স্বজন হাড়াভাঙ্গা গ্রামে ইছামতি নদীর উত্তর পাড়ে তার দাফন করেন,বর্তমানে নদীর অস্তিত্ব বিলিন হয়ে গেলেও, একটু বিলের মত রেখা দেখা যায়। তবে বহু বছর পার হলেও তার কবর খানা সংরক্ষিত আছে, যা এলাকাবাসীর কাছে তার কর্মময় জীবনের বহু ঘটনা জানাগেছে।
এক ঘোষ আলম ফকিরের কাছে ঘোল খাওয়া বাবদ কিছু টাকা পাওনা ছিল, হঠাৎ ভেড়ামারা উপজেলার হাওয়া খালি নামক স্থানে ফকিরের সাথে ঘোষের সাক্ষাৎ হয়। ঘোষ তার পাওনা টাকার জন্য বললে আলম ফকির জানান তার বাড়ীতে স্ত্রীর কাছে গিয়ে কোরআন শরীফের অমুক পাতায় টাকা আছে, সে যেন দিয়ে দেয়। ঘোষ জানতো না আলম ফকির মারা গেছেন, আলম ফকিরের কথামত ঘোষ তার বাড়ীতে গিয়ে ফকিরের স্ত্রীর কাছে এ কথা বললে বাড়ীর সবাই অবাক হয়ে যায় এবং ঘোষের কথা যাচাই করার জন্য বাড়ির সবাই কোরআন শরীফের মধ্যে ঠিক ঐ পাতায় টাকা দেখতে পায়।
আলম ফকিরের নিষেধ ছিল ঘোষ যেন না বলে তার সাথে সাক্ষাৎ হয়ে ছিল, বললে ঘোষের ক্ষতি হবে। বাড়ীর লোকজনের চাপের মুখে ঘোষ এক পর্যায়ে বলে দেয় আলম ফকিরের সাথে তার স্বাক্ষাৎ হয়ে ছিল। ফকিরের কথা রক্ষা করতে না পারায় ঐ দিন ঘোষ চরম অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং কিছুদিন পর মারা যায়। এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে আলম ফকিরের প্রতি চরম বিশ্বাস জন্ম নেয় এবং তার দরগা স্থলে নানা রকম উপকরণ মানত করা শুরু করে।
আলম ফকিরের জীবদ্দশায় বেশ কিছু ঘটনার কথা লোকমুখে শোনাগেছে, তার অনেক গুলি গরু ছিল, কেহ চাষ কাজের জন্য চাইলে জেনে নিতেন কতটুকু জমি চাষ হবে, চাষীর ঠিক ঐ পরিমাণ জমি চাষ হলেই গরু আর হাটত না, আবার গাভী গরুর দুধ কেহ চাইলে কতটুকু দুধ তার দরকার জেনে নিতেন, ঠিক সেই পরিমাণ দুধ দহন হলেই গাভী গরু দুধ দেওয়া বন্ধ হয়ে যেত।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান শাসনামলে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে দরগা স্থলে একটি টিনের ছাউনি দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মসজিদটির নামকরণ করা হয় “আল্লারদর্গা” জামে মসজিদ, এই মসজিদ এবং এলাকাটি আলম ফকিরের দরগার স্মৃতি বহন করে চলেছে।
এমনি ভাবে ছোট খাট অনেক অলৌকিক ঘটনা এখানকার মানুষকে বিষ্মত করে তোলে। তাই দুর-দূরান্ত থেকে রোগ মুক্তির জন্য মানুষ, ছাগল, মোরগ সহ নানা রকম উপঢৌকন এনে হাজির হয় মসজিদে মানত আছে বলে। তাদের কাছে শোনাগেছে বন্ধত্বসহ কঠিন রোগ মুক্তির অবাক হওয়ার মত অনেক কথা। তাই এই নামের বরকতে স্থানটির মর্যাদা যুগ যুগ ধরে অম্লান হয়ে আছে। এখনো শোনা যায় অলৌকিক ঘটনার অনেক কথা, তাইতো এখানে মানত করে রোগ মুক্তি পেতে চায় অনেক মানুষ। এলাকার দৌলতপুর উপজেলার মিরপুর ও গাংনি থানার হাড়াভাঙ্গা গ্রামে এ ফকিরের বহু আত্বীয় স্বজন আছে, তারা জানায় আমরা সপ্তম পুরুষ হয়ে বেঁচে আছি।
আল্লারদর্গা নাম করণের ইতিহাস লেখক ও গবেষক খন্দকার মোঃ জালাল উদ্দীন, আল্লারদর্গা, দৌলতপুর, কুষ্টিয়া।