কুষ্টিয়ায় বাসের ইচ্ছাকৃত ধাক্কায় প্রাণ হারানো শিশু আকিফার মা রিনা খাতুনের কান্না যেন থামছেই না। কিছুতেই মনকে বোঝাতে করতে পারছেন না তিনি। নিজের কোল থেকে আদরের সন্তানকে কেড়ে নিয়ে যাওয়ার সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি প্রতিমুহূর্ত তাকে তাড়া করছে। সন্তানকে রক্ষা করতে না পারার যন্ত্রণা তাকে বার বার কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কিছুতেই তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না।
অপরদিকে যক্ষের ধন আদরের সন্তানকে নিজ হাতে কবরের মাটিতে শুইয়ে দিয়ে আসার পর থেকে পাগলপ্রায় আকিফার বাবা হারুন অর রশীদ। রিনা খাতুন আর হারুন অর রশীদকে আত্মীয়-স্বজন কেউই সান্ত্বনা দিতে পারছেন না।
বাসের ইচ্ছাকৃত ধাক্কায় প্রাণ হারানো আট মাস বয়সী শিশু আকিফা খাতুনের কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাস মোড় এলাকার বাড়িতে শুক্রবার গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে তখনও শোকের মাতম চলছে। আদরের সন্তানকে হারিয়ে সেই থেকে মা রিনা খাতুন কেঁদেই চলেছেন। বাবা হারুন অর রশীদ যেন পাথর হয়ে গেছেন। কেউই তাদেরকে সান্ত্বনা দিতে পারছেন না। গত দুদিন ধরে না খেয়ে আছেন রিনা খাতুন। হারুন অর রশীদের বৃদ্ধ মা খোদেজা বেগম গত ছয় মাস ধরে বিছানায় পড়ে আছেন। শরীর এতটাই দুর্বল যে বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। নাতনিকে হারিয়ে তিনিও অনবরত কেঁদেই চলেছেন।
রিনা খাতুন আর হারুন অর রশীদ দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ছিল আকিফা খাতুন। বয়স মাত্র আট মাস। সবার বড় ছেলে রোহান (১৫) কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র। আর মেয়ে রাণী (১২) কুষ্টিয়া কালেক্টরেট স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। হতদরিদ্র হারুন অর রশীদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। জীবিকার তাগিদে কখনো ভুসি মালের ব্যবসা আবার কখনো সবজির ব্যবসা করেন হারুন অর রশীদ।
কান্নায় ভেঙে পড়ে আকিফার মা রিনা খাতুন বলেন, সেদিন কেন যে বাপের বাড়ি যেতে চাইলাম? না গেলে হয়তো বাস আমার আকিফাকে এভাবে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারতো না।
শিশুটির বাবা হারুন অর রশীদ বলেন, মেয়ে আকিফাকে নিয়ে মঙ্গলবার সকালে রিনা দহকোলায় আমার শ্বশুরবাড়ি যেতে চায়। কিন্তু আমার পকেটে একটা টাকাও ছিল না। রিনাকে বলি তুমি চৌড়হাসের নুপুর বেকারি থেকে আমার কথা বলে একশো টাকা চেয়ে নিয়ে দহকোলা চলে যাও। ঘটনার দিন মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে রিনা মেয়ে আকিফাকে কোলে করে চৌড়হাস থেকে বাসে ওঠার জন্য রাস্তা পার হচ্ছিল। বাসটিকে থামা অবস্থায় দেখতে পেয়েই আমার স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে বাসের সামনে দিয়ে পার হচ্ছিলেন। কিন্তু চালক হর্ন না দিয়েই বাসটি চালিয়ে দেন।
তিনি বলেন, বাসের ধাক্কায় মাথায় এবং চোখে আঘাত লেগে মারাত্মক আহত হয় আকিফা। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে দ্রুত কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। অবস্থার অবনতি হলে ওই দিন সন্ধ্যায় অ্যাম্বুলেন্স যোগে আকিফাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। দুদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে বৃহস্পতিবার ভোরে না ফেরার দেশে চলে যায় আকিফা।
হারুন অর রশীদ বলেন, অনেকেই আমার কাছে ক্ষতিপূরণের কথা বলছেন। আমি ক্ষতিপূরণ দিয়ে কী করবো? আমি আমার সন্তান হারানোর বিচার চাই। ঘাতক ওই বাসের চালক ও হেলপারের ফাঁসি চাই।
এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ রাস্তার ধারে থাকা শিশু গাছের সঙ্গে লাগানো সোহাগ জুয়েলার্স সিসি ক্যামেরায় ধারণ হয়। ফুটেজে দেখা যায়, বাসটি দাঁড়িয়ে ছিল। বাসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বাসটি হঠাৎ করেই চলতে শুরু করে। এতে ধাক্কা লাগে। এমন ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। বিচারের দাবিতে বুধবার স্কুলের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা মানববন্ধন করে।
এদিকে বৃহস্পতিবার (৩০ আগস্ট) রাতে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছেন হারুন অর রশীদ। মামলায় ঘাতক বাসের চালক খোকন, সুপারভাইজার ইউনুস মাস্টার ও মালিক জয়নুলকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা সবাই ফরিদপুর জেলা সদরের বাসিন্দা।