১৮৯১সালে স্থাপিত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত সাহিত্য তীর্থ কুষ্টিয়া কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ কুঠিবাড়ি প্রমত্ত পদ্মার ভাঙ্গন থেকে রক্ষায় সরকারের নেয়া “কুষ্টিয়া জেলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ” প্রকল্পটি ব্যাপক অনিয়ম, দূর্ণীতি, নির্ধারিত পরিকল্পনাসহ নঁকসা লংঘন, অর্থ অপচয় এবং বরাদ্দকৃত টাকা প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় না করে অব্যয়িত রাখায় প্রায় ২শ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্রকল্পটি এখন ধ্বংসের মুখে। ফলে সরকার যে গুরুত্ব বিবেচনায় বাঙালীর অন্যতম এই ঐতিহ্য শিলাইদহ কুঠিবাড়ি রক্ষায় প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিলো তা এখন ভেস্তে যেতে বসেছে। এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেই দায়ি করে ক্ষতিপূরন আদায়সহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়ম-অনিয়ম যা কিছু হয়েছে সবই পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরামর্শেই হয়েছে।
স্থানীয় সুলতানপুর গ্রামের আলাউদ্দিন সেখ অভিযোগ করে বলেন, এই কাজের ঠিকাদাররা স্থানীয়দের সাথে চরমভাবে মাস্তানী করে সন্ত্রাসী কায়দায় ঘরবাড়ি ভেঙ্গে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ না দিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজ করেছে। প্রকল্প শুরুর সময় ঢাকা থেকে বড় বড় অফিসাররা এখানে এসে স্থানীয়দের সাথে কথা বলেছিলেন, স্থানীয়দের সুবিধা অসুবিধা বিবেচনায় রেখে কাজ করার কথা। কিন্তু তারা সেটা করেন নি। উপরন্ত সন্ত্রাসী বাহিনী ও পুলিশ দিয়ে স্থায়ী বাসিন্দাদের হয়রানি করেছে। অটো মেশিনে তৈরী যেসব ব্লক দিয়ে পার বেধেছে সেগুলি সব এখন পানির ঢেউয়ে ধুয়ে চলে যাচ্ছে।
শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে কর্মরত কাস্টোডিয়ান মুখলেচুর রহমান জানান, বাঙালী জাতির ঐতিহাসিক হেরিটেজ বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত সাহিত্য চর্চার তীর্থ শিলাইদহ কুঠিবাড়ি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী যে উদ্যেগ গ্রহণ করেছেন তা প্রকৃত অর্থে কুঠিবাড়ি রক্ষার জন্যই করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এখানে যে কাজ হয়েছে তাতে কুঠিবাড়ি রক্ষার কাজ হয় নাই। নির্মান কাজ পুরোপুরি সমাপ্ত না করেই প্রকল্পটি ক্লজ করে দেয়া হয়েছে। অথচ মূল ঝুঁকিপূর্ন জায়গাটি কাজের বাইরে রেখে কিভাবে কুঠিবাড়ি রক্ষা হবে ? কুঠিবাড়িকে উদ্দেশ্য করে কেবলমাত্র ব্যবসায়িক ফায়দা না নিয়ে বরং প্রকৃত ভাবে কুঠিবাড়ি রক্ষায় যে কাজটি করা দরকার তা না করলে উদ্দেশ্য ব্যহত হতে বাধ্য।
উপজেলার কয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউল ইসলাম স্বপন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, স্থানীয় জনগণের ক্ষতি সাধন, নিন্মমানের সামগ্রী ব্যবহার, নির্ধারিত পরিকল্পনা ও নঁকসা বহির্ভুত, প্রয়োজনীয় সামগ্রী অব্যবহৃত রাখা, ব্যয়িত অর্থের অপচয়, অনিয়ম ও দূনীতির মধ্যদিয়ে অসম্পূর্ণ প্রকল্প সম্পন্ন দেখিয়ে হস্তান্তর করে প্রভাবশালী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অঙ্গ সংগঠন ‘ডিজেল প্লান্ট’ এবং সহযোগী ‘ওয়েষ্টার্ন ইঞ্জিয়ারিং কোং’ এর দৌড়াত্ম এবং কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ন ও যোগসাজসে প্রায় ২শ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত “কুষ্টিয়া জেলায় বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এবং পাশ^বর্তী এলাকায় পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ” প্রকল্পটি এখন ধ্বংসের মুখে।
স্থানীয় শিলাইদহ ইউপি চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিন তারেক বলেন, ইউপি চেয়ারম্যন হিসেবে দায়বোধ থেকে প্রকল্প নির্মান কাজ দেখতে মাঝে মধ্যে গিয়েছি। সেখানে কিছু কিছু অনিয়মও দেখেছি; বিষয়গুলি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের নজরে নেয়ার অনুরোধ করেছি। আমি ইঞ্জিনিয়ার নই, মূল কাজের ড্রয়িং-ডিজাইন কিংবা পরিকল্পনা অতো বিস্তারিত বুঝি না। আমাদের চোখে যেগুলি অনিয়ম মনে হয়েছে সেগুলি বলেছি। তাছাড়া এই কাজের সাথে আর্মিরা থাকায় খুব বেশী কিছু বলারও ছিলোনা। এখন দেখছি যেভাবে প্রকল্প শেষ হয়েছে তাতে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি রক্ষার কাজ হয়নি।
মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিজেল প্লান্টের সাথে নির্মাণ কাজ সম্পন্নকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েষ্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোং এর প্রকল্প তদারককারী প্রকৌশলী রাজিব বলেন, প্রকল্প মেয়াদের শর্তানুযায়ী ৩১মে থাকলেও গত ৩০জুন ২০১৮ তারিখে অসম্পূর্ণ প্রকল্পকে সম্পূর্ণ হয়েছে দেখিয়ে কাগজে কলমে দাপ্তরিক নিয়মে হস্তান্তরের মধ্যদিয়ে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি রক্ষাবাধ প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষনা করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া। যদিও এপ্রকল্পের অর্থব্যয়ে তৈরী ১৩ লক্ষ ব্লকের মধ্যে ২লক্ষ ৫০হাজার ব্লক অব্যবহৃত পড়ে আছে যেখানে শর্তানুযায়ী মেইন্ট্যানেন্স কাজের জন্য মাত্র ৬% রাখার কথা। কিন্তু পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন করে ভাঙ্গন সৃষ্টি হওয়ায় ঝুকিতে পড়েছে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। এই প্রচারণাকে আবার চাওড় করে আরডিপিপি অনুমোদনের মধ্যদিয়ে সমাপ্ত হওয়া প্রকল্পটি সম্প্রসারণের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রকল্প নির্মাণকারী মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিজেল প্লান্ট ও সহযোগী ওয়েষ্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোংসহ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার যোগসাজসেই চলছে এসব। আরডিপিপি অনুমোদন পেলে অসম্পূর্ন কাজসহ ত্রুটি বিচ্যুতিগুলি মেরামত করা হবে বলে জানালেন ওয়েষ্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোং এর কর্তব্যরত এই প্রকৌশলী রাজিব ও সাইট কর্মী সুজন আলী। হস্তান্তরিত প্রকল্পের পরিকল্পনা ও নঁকসার কোন হেরফের হয়ে থাকলে তা পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার কর্মকর্তাদের পরামর্শেই হয়েছে বলে জানান তিনি।
এবিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশল আরিফুজ্জামান খান বলেন, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়নে “কুষ্টিয়া জেলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ” প্রকল্পের সুলতানপুর অংশে ২হাজার ৭২০ মিটার এবং শিলাইদহ অংশে ১হাজার মিটার সংরক্ষন বাধ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু দুই অংশের মাঝখানে ১হাজার ৫শ ৩০মিটার কাজ না হওয়ার ফলে নতুন করে সৃষ্ট নদী ভাঙ্গন নির্মিত বাধ এবং শিলাইদহ কুঠিবাড়িকে ঝুকির মধ্যে ফেলেছে এমন কথা শিকার করেই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক হস্তান্তরিত অসমাপ্ত প্রকল্পের কিছু অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেন এবং সেকারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরনসহ শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানালেন পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী।
থানীয় সংসদ সদস্য(কুমারখালী-খোকসা) কুষ্টিয়-৪ আব্দুর রউফ বলেন, আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত ও প্রভাবশালী সন্ত্রাসীদের আঁখড়ায় পরিনত কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক কোন কাজই সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়না। তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানান, শিলাইদহ কুঠিবাড়ি রক্ষা প্রকল্পটির বাস্তবায়নে যে সব ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও নঁকশা বহির্ভুত কাজ হয়েছে এবং অসম্পূর্ণ প্রকল্প সম্পূর্ণ দেখিয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবেন। শিলাইদহ কুঠিবাড়ি রক্ষা প্রকল্প যেন সত্যিকার অর্থেই কুঠিবাড়ি রক্ষায় স্থায়ী ও টেকসই প্রকল্প হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানালেন স্থানীয় সংসদ সদস্য।